দার্শনিক লালন ফকির ( সাঁই ) - বাউল গান ও তার জীবন দর্শন :


দার্শনিক লালন ফকির - বাউল গান ও তার জীবন দর্শন :


অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতাব্দীতে এক রহস্যবাদী সাধক সম্প্রদায় অনেক উৎকৃষ্ট আধ্যাত্বিক সংগীত রচনা করেন, সেগুলি বাউল সংগীত নামে পরিচিত।

লালন ফকির

লালন ফকির ( সাঁই )

বাউল শব্দের অর্থ কি?

বাউল শব্দের বুৎপত্তিগত অর্থ নিয়ে নানা মত প্রচলিত আছে। সংস্কৃত 'বাতুল' বা 'ব্যাকুল' শব্দ থেকে এর উৎপত্তি বলে অনেকে মনে করেন। তবে আরবি শব্দ 'আউল' বা হিন্দী শব্দ 'বাউর' থেকেও এর উৎপত্তি অসম্ভব নয়।

বাউল কাদের বলা হয়?

সমাজ বহির্ভূত ধর্মনিরপেক্ষ সংসার উদাসীন ভ্রাম্যমান ভিক্ষাজীবী গায়ক,যারা এক রহস্যময় অদ্ভুত পন্থার সহজিয়া ও মরমীয়া সাধক, তাদের বাউল বলা হয়।

বিষয়বস্তুর দিক থেকে বাউল গান নিঃসন্দেহে উৎকৃষ্ট সৃষ্টি। হরিনাথ মজুমদার মহাশয় প্রথম বাউল গানের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং অনেকগুলি বাউল গান সংগ্রহ করেন। রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে থাকাকালীন বিশিষ্ট বাউল সাধক লালন ফকিরের গানের পরিচয় পান এবং সেই সময় প্রবাসী পত্রিকায় লালন ফকিরের কুড়িটি গান প্রকাশ করেন।এর ফলে শিক্ষিত সমাজ লালন ও বাউল গানের প্রতি বিশেষভাবে আকৃষ্ট হন।অতঃপর অধ্যাপক ক্ষিতিমোহন সেন শাস্ত্রী,ইন্দিরা দেবীচৌধুরানী, অধ্যাপক মনসুরউদ্দিন আহমেদ ও ড. উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য প্রমুখ ব্যাক্তিরা বাউল গান সম্পর্কে বিস্তৃত মূল্যবান আলোচনা করেন। তাদের আলোচনায় বাউল সাধনার তত্ত্ব, আধ্যাত্মিক দিক ও সাহিত্যমূল্য পরিস্ফুট হয়েছে।
বাউল সংগীত বাংলার সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য সম্পদ। ঈশ্বর প্রেমে যারা পাগল বা মাতোয়ারা তারাই বাউল। কৃষ্ণদাস কবিরাজ 'চৈতন্যচরিতামৃত' গ্রন্থে এই অর্থে বাউল শব্দের একাধিকবার প্রয়োগ করেছেন। চৈতন্যদেব নিজেকে বাউল বলতেন। যেমন একটা দৃষ্টান্ত -

"আমিতো বাউল আন  কহিতে আন কহি। 
কৃষ্ণ মাধুর্য্য স্রোতে আমি যাই বহি।।"

এছাড়া ভিন্ন অর্থেও 'চৈতন্যচরিতামৃত' - এ বাউল শব্দের প্রয়োগ ঘটেছে। যেমন -


"স্থির হঞা ঘরে যাও না হও বাউল।
 ক্রমে ক্রমে পাই লৌক ভবসিন্ধু কুল।।"


এই সমস্ত উক্তিই প্রমান করে চৈতন্য যুগে সমাজ-সংসারের বাস্তব জীবন সম্পর্কে উদাসীন এক শ্রেণীর ঈশ্বর ভক্ত সাধক বাউল নামে পরিচিত ছিলেন। অদ্বৈত আচার্য মহাপ্রভুকে বাউল আখ্যা দেন। ঈশ্বরের ভাবরসে মাতাল ব্যক্তিরা সমাজে বাউল নামে অভিহিত হন। সহজিয়া পদেও যাদের ধর্ম কর্ম আচার-আচরণ রহস্যময়, নানা অসঙ্গতিপূর্ণ তাদের বাউল নামে চিহ্নিত করা হয়েছে। আরবি 'আউর' ও হিন্দু 'বাউল' শব্দের অর্থ বায়ুরোগগ্রস্ত। আউল-বাউল শব্দটি দুটিও একত্রে প্রয়োগ হতে দেখা যায়। আকুল থেকে আউল বা সুফি ওয়ালির শব্দের বহুবচন থেকে আউল শব্দ আসতে পারে। ওয়ালি মানে নিকটস্থিত ব্যাক্তি ওয়ালিয়া শব্দের অর্থে ঈশ্বরের সান্নিধ্যে স্থিত সাধক।একদা আমাদের দেশে ঈশ্বর ভক্ত মুসলমান সাধকরা আউলিয়া নামে পরিচিত ছিলেন।
আচার্য ক্ষিতিমোহন সেন কাল বিচার করে দেখাতে চেয়েছেন বাউলের উৎপত্তি ষোড়শ শতকের শেষ পাদে। তার মতে জগমোহন নামে সাধক প্রায় চারশ বছর আগে জগমোহনী বাউল সম্প্রদায় গঠন করেন। প্রায় আড়াইশ' বছর আগে আবির্ভাব ঘটে আউলচাঁদ ফকিরের। তিনি একতারাশ্রয়ী বাউল গীতির ঐতিহ্যের স্রষ্টা।এ থেকে অনুমান করা যেতে পারে যে ষোড়শ শতাব্দীর শেষের দিকে এবং সপ্তদশ শতাব্দীর প্রারম্ভে লোকসাধনা ও লোকসংগীত হিসেবে সমাজে বাউল গীতির বিস্তার ঘটতে থাকে। এই সময়ে ব্রাহ্মণ্য সংস্কারমুক্ত লোকস্বভাব ও লোক সংস্কৃতির পুনর্জাগরণ ঘটে।
এক কথায় জাতি সম্প্রদায়ের শাস্ত্রাচারের গণ্ডি বন্ধন থেকে মুক্ত ও স্বাধীন এক দল ঈশ্বর প্রেমিক ৪২৫ বছর আগে থেকেই এদেশে বাউল নামে পরিচিত হয়ে আসছেন। লোক চক্ষুর অন্তরালে তাদের সাধনার ক্ষেত্র।
বাউল সম্প্রদায় সকল প্রভাব থেকে মুক্ত থেকে বৌদ্ধ সহজিয়া মতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগসূত্র রাখতে সক্ষম হয়েছেন। বাংলাদেশে বৈষ্ণব ধর্ম ও সাহিত্যের ব্যাপক বিকাশ ঘটলে যে সহজ মানবতার আদর্শ সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয় - সেই পরিপ্রেক্ষিতের সুযোগে বাউল গান সমাজে আসার সুযোগ পেল। এর সঙ্গে সুফি প্রেমধর্মের আদর্শও মিশ্রিত হয়েছে।এক কথায় বাউল গান বৌদ্ধসহজিয়া,
বৈষ্ণব ও সুফিমার্গের সাধনা। বৈষ্ণব সহজিয়া সম্প্রদায়,সুফিয়া আউলিয়া সম্প্রদায়,শৈবনাথ,ধর্ম,যোগতন্ত্র,হঠযোগ প্রভৃতি ধর্ম ও উপধর্মের কায়সাধনা তত্ত্ব অবলম্বনে বাউলরা আধ্যাত্বসাধনায় একপ্রকার গুহ্যক্রিয়াকর্ম অনুশীলন  করে, তারা জাতপাতের ভেদাভেদ না মানলেও সহজিয়া পন্থী হিন্দু বাউল ও সুফিপন্থী  মুসলমান ফকির বাউল ( আউলিয়া ) রয়েছে তবে। তবে এদের মধ্যে ক্রিয়াকর্মের বিশেষ কোনো পার্থক্য নেই। হিন্দু বাউলরা সহজিয়া বৈষ্ণব সাধকদের মতো দেহের মধ্যে অসীম প্রেমরস উপলব্ধি করতে প্রয়াসী। সহজিয়ারা প্রকৃত মানুষের উপর রাধাকৃষ্ণতত্ত্ব  আরোপ করে অদ্বৈতানুভূতি লাভ করতে চান। আর হিন্দু বাউল দেহের মধ্যেই মনের মানুষ,অচিন পাখি বা অধরা মানুষকে ধরতে চান। যাকে যায় না ধরা তারই হাওয়ার স্পর্শে বাউলরা আকুল ব্যাকুল। তারা সীমাবদ্ধ মানবসত্তাকে ভাগবতীসত্তায় এক করে দিতে বদ্ধপরিকর। দেহের মধ্যে ক্ষুদ্র আমিকে অসীম অখন্ড আমির সঙ্গে এক করে নিতেই তাদের সাধনা।

অবশ্যই পড়ুন - ধ্যানের মহান শক্তি 

বাউলদের সঙ্গে সূফীদের মিল রয়েছে। ইরানের সূফী সাধকগণ স্বর্গকামনা চাননি, মুক্তি চাননি,শুধু ভগবানকে ভালোবাসার মধ্যে পেতে চেয়েছেন। প্রেমিক-প্রেমিকার ( মাসুক-আশিক) কামনারাগের মধ্যেই তারা ভগবানের সান্নিধ্য পেতে প্রয়াসী। মুসলমান বাউলদের ফানা হিন্দুবাউলদের 'জ্যান্তে মরার' সমতুল্য। আচার-আচরণ ও তত্ত্ব দর্শনে উভয় সম্প্রদায় বাউলের মধ্যে সাদৃশ্য আছে। মুসলিম বাউলদের ফানা হল ব্যক্তিসত্তা বিলোপ সাধন, 'বাকা' হল ঈশ্বরসাযুজ্যলাভ। তাদের মতে নবী ও সাধারণ মানুষ সকলের মধ্যে আল্লাহ আছেন। সাধারণ মানুষের মধ্যে আল্লাহ প্রচ্ছন্ন। নবীদের মধ্যে তার পূর্ণ স্বরূপ প্রকাশ পায়। যারা আল্লাহর প্রেমে মাতোয়ারা ( মজ্জুব ) ও পাগল (দিওয়ানা ) তাঁরাই তাঁকে লাভ করেন। মানবদেহেই আদি মক্কা রয়েছে। বাইরের মক্কায় ছোটার প্রয়োজন নেই। সুফি মতে চার প্রকার সাধনা  -

(১) গুরুর মধ্যে বিলীন হওয়া ( ফানা কিস শেখ )।
(২) ঈশ্বরের অবতারের মধ্যে বিলীন হওয়া ( ফোন -ফের-রসুল)।
(৩) ঈশ্বরের মধ্যে বিলীন হওয়া (ফোনা-ফিস-আল্লা)।
(৪) ঈশ্বরের মধ্যে একাত্ম হওয়া (বকাবিল্লা)।

বাউল সংগীত দেখা যায় হিন্দু বাউল ও মুসলমান বাউল পরস্পর উভয়ের অনেক পারিভাষিক শব্দ প্রয়োগ করেছেন।
হিন্দু ও মুসলিম উভয় বাউল সাধরণত গুরুবাদি। মুসলমান বাউলদের মুর্শিদা গানে দেখা যায় মুর্শিদের (গুরু) কৃপাতেই সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেন - 'আমার ছিড়িল হালের পানস নৌকায় খাইলো পাক। মুর্শিদ রইলাম তোর আশে।' হিন্দু বাউল গানেও ভাগবত বৈশিষ্ট্য প্রায় এক -

"গুরু যে তোর বরণডালা গুরু যে তোর মরণজ্বালা 
গুরু যে তোর মনের ব্যথা (যে ) ঝরায় দু'নয়ন।"

আবার একশ্রেণীর হিন্দু-মুসলমান বাউল গুরুকে তুচ্ছ করেছেন। এতে মনে হয় বাউল সম্প্রদায়ের মধ্যে একদল গুরুতত্ত্ব তন্ত্রেমন্ত্রে ও গুরু নির্দেশিত সাধন-ভজনের ক্রিয়াকর্মে বিশ্বাসী ছিলেন। অন্যদল গুরুর নির্দেশ বা কোন নিয়মই মানতেন না। লালন ফকিরের গানে গুরুর শাসন লঙ্ঘিত হয়েছে -

"আছে যার মনের মানুষ মনে সে কি জপে মালা।
 অতি নির্জনে বসে বসে দেখছে খেলা।।"
কাছে রয় ডাকে তারে উচ্চস্বরে কোন পাগলা।।"


বাউল সাধনার আধ্যাত্মিক তাৎপর্য হলো মানব দেহের মধ্যেই অমৃত আছে - 'যাহা আছে ব্রহ্মাণ্ডে তাহা আছে দেহ ভান্ডে।' দেহের মধ্যেই মনের মানুষের অবস্থিতি।দেহ মন্দিরেই ভগবানের অধিষ্ঠান। এই জীবদেহে তাকে আবিষ্কার করতে পারলেই সাধকের মুক্তি ঘটে।বাউল মতে,মানবদেহে অনন্ত- অসীমকে-অধরাকে ধরার জন্যই তাদের সাধনা। জীবনমৃত্যু,আলো-অন্ধকার ও সীমা-অসীমের চেতনার ঊর্ধ্বে এক নির্বিকল্প অক্ষয়বোধের মুক্তিরস উপলব্ধিই তাঁদের কাম্য। এককথায় জড়সত্তাকে বিনষ্ট করে দেহ ও মনে পরমার্থ সন্ধানী হয়ে উঠায় বাউল সাধনার মর্মবাণী। সেই পরমার্থ বাউলের ভাষায় 'সাঁই'।
বাউল সাধনার মূলতত্ত্বকে আশ্রয় করেই বাউল সংগীত রচিত হয়েছে। প্রকৃত দেহচর্চার মধ্যে দিয়েই তারা সূক্ষ্মতম মোক্ষানন্দ লাভ করতে প্রয়াসী। নর-নারীর দেহকে তারা রাধাকৃষ্ণের অপ্রাকৃত দেহ কল্পনা করেছেন। জীবদেহে রাধাকৃষ্ণ বা শিবদুর্গার মিলনানন্দ ভোগ করে মোক্ষের প্রথম সোপানে পৌঁছাতে চান। আরে এক শ্রেণীর বাউল স্ত্রী-পুরুষে মিলে কামকে প্রেমে পরিণত করেন। তারা বলেন দেহের ভিতর মনের মানুষ বাস করেন। দৈহিক  আসক্তি ও দেহ-ভোগের মধ্য দিয়ে দেহাতীত সুক্ষসত্তাকে উপলব্ধি করতে হবে। তাই বাউলদের সাধনায় রক্তমাংসের বিক্ষোভ পরিপূর্ণভাবে স্থান পেয়েছে। এরা নিরক্ষীয় তত্ত্ব ( রজঃ ও শুক্র ) চারি চন্দ্রতত্ত্ব গোপনে অনুষ্ঠান করেন। সাধক স্ত্রীধর্মের তিন দিনে নারীদেহ অবলম্বন করে চতুর্থ দিনে অধরাকে স্বীকার করেন। স্ত্রী পুরুষ বিশেষ দৈহিক প্রক্রিয়ায় শৃঙ্গারে অচঞ্চল আনন্দানুভূতিকে ঊর্ধ্বগামী করে সহজস্বরূপ মনের মানুষের সঙ্গে মিলিত হন। তাই বাউল সাধনার পরমতত্ত্ব হলো প্রকৃতি পুরুষের বিশেষ মৈথুনজাত মহোল্লাস। এই দেহ সাধনা আধুনিক মানুষের কাছে বিভৎস-কুশ্রী মনে হতে পারে। তবে বাউল সাধনায় দেহ যন্ত্রস্বরূপ। দেহসুখ লক্ষ্য নয়, উপলক্ষ। দেহ যন্ত্র বাজিয়ে লক্ষ্যে উপনীত হওয়া অর্থাৎ পরমসত্তার সঙ্গে মিলিত হওয়ায় মুলকথা। তবে উপলক্ষ অনেক সময় লক্ষ্যকে অতিক্রম করে প্রধান হয়ে ওঠে। সেখানে অধিকারী ভেদের প্রশ্ন আছে। সে যাহোক, বাউল সাধনা ভারতের বিচিত্র ধর্মসাধনাকে সাঙ্গীকৃত করে নিয়েছে। এই সম্পর্কে ডঃ শশীভূষণ দাশগুপ্তের উক্তি প্রনিধানযোগ্য -
 
"In the conception of the 'Man of the heart" of the Baul, we find a happy mixture of the conceptoin of the paramatmana of the Upanisadas, the sahaja of the sahajiya's and Sufi-istic conception of the Beloved."

বাউলরা সহজিয়া জীবন সাধক। মানুষকে জানাই এদের প্রধান সাধনা। একতারা এদের গানের সহচর। গভীরতর অর্থে এরা বৈরাগী।এদের প্রধান ধর্ম উদাসীনতা।সংসার,জীবন ভোগ-বাসনা সবকিছুকে এরা স্বীকার করেছে - সবকিছুর সঙ্গেই এদের  সহজ সম্পর্ক। আর সমস্ত কিছুকে গ্রহণ করেও এরা আশ্চর্যভাবে উদাসীন।
বাউল সাধনায় পৌত্তলিকতার কোন স্থান নেই। সমাজজীবনের কোন মধ্যে এরা আবদ্ধ নয়। কৃত্রিম সামাজিক আচার সংস্কার,বিধি-বিধান,জাত-পাত, লোকাচার,শ্রেণীভেদ, বর্ণভেদ ও শাস্ত্রসংহিতা সবকিছুই এরা অগ্রাহ্য করেছে -

"তাই তো বাউল হৈনু ভাই 
এখন বেদের ভেদবিভেদের 
আর তো দাবি-দাওয়া নাই।।"

বাউলদের কাছে মনই উপাসনার একমাত্র মন্দির। মনের মানুষ সেই মন্দিরের দেবতা -

"আছে যার মনের মানুষ আপন মনে 
সে কি আর জপে মালা।
নির্জনে সে বসে বসে দেখছে খেলা।"


বাউলদের কাছে তাই মন্দির মসজিদ পূজা-অর্চনা রোজনামচা, শাস্ত্রবিধি, জাতি পঙক্তি, তীর্থভেদ প্রতিমা সবই নিরর্থক। মানবতায়ই তাদের সাধনার লক্ষ।মানুষের মধ্যেই বিশ্বচরাচর 
'তোরি মধ্যে অতল সাগর।' তাঁদের সাধনার মূলমন্ত্র প্রেম। বাউলরা আলোর পূজারী, প্রেমের উপাসক,সহজ জীবনের পদাবলী রচয়িতা। রবীন্দ্রনাথ এ সম্পর্কে খুব সুন্দর মন্তব্য করেছেন 


"ওরা অন্ত্যজ, ওরা মন্ত্রবর্জিত।...

ওরা দেবতাকে খুঁজে বেড়ায় তাঁর আপন স্থানে।
সকল বেড়ার বাইরে
সহজ ভক্তির আলোকে,
নক্ষত্রখচিত আকাশে 
পুষ্পে খচিত বনস্থলীতে
দোসরজনার মিলন -বিরহের
গহন বেদনায়।



অষ্টাদশ শতাব্দীতে বাংলাদেশে ধর্মীয় শোষণ ও সামাজিক অবিচার  প্রবল আকার ধারণ করে। জাতিভেদ,অস্পৃশ্যতা,ধর্মীয় ব্যভিচার ও সম্প্রদায়ভেদে সাধারণ মানুষ নিদারুণভাবে পীড়িত  হয়। বাউল গানে নানা অনাচার ও ভেদাভেদে লাঞ্ছিত পর্যুদস্ত মানুষকে দুর্গতি থেকে মুক্তির বাণী প্রচারিত হয়েছে। বাউলরা যে সমাজ জীবনের প্রতি উদাসীন তা সমাজে মানবতার অধোগতির জন্যই। তাই সামাজিক বিধি-বিধান, আচার-অনুষ্ঠান, শাস্ত্র সংহিতা, ব্রাহ্মণ্য ধর্মের গোঁড়ামি ও অনুদারতা এবং দেব মন্দির ও প্রতিমা পূজার বিরুদ্ধে তাদের মানসিক প্রতিক্রিয়া বাউল সংগীতে পরিস্ফুট। সহজ মানবতা ও আত্মিক সাধনার জন্য মানুষের প্রতি আহ্বান ধ্বনিত হয়েছে বাউলদের সংগীতে। 
পরমার্থের সাধনা করতে গিয়ে বাউলরা উদার ও প্রেমাদর্শের জয়গান রচনা করেছে। জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে মানবিক ঐক্যের বাণী প্রচারিত হয়েছে তাদের কন্ঠে। বাউলদের মতে সর্বমানবসত্তা নিগূঢ় তাৎপর্যে এক ও অবিভাজ্য। তাই বাউলরা মানুষকে মানুষ হিসেবে স্বীকার করে,একে অপরের শিষ্য হয়। ধর্ম ও জাতিভেদ উপেক্ষা করে। এদের কাছে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে কোন ভেদাভেদ নেই। এর ফলে বাউল সাধনার পতাকাতলে মুক্তমনে মিলিত হয়েছে উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ। সমকালীন নানা আচার সংস্কারে আবদ্ধ ও ভেদাভেদে খন্ডছিন্ন এবং অবিচারে-অপমানে-অত্যাচারে দুর্গত মানুষের মধ্যে বলিষ্ঠ আত্মপ্রত্যয় জেগে উঠেছে। গড়ে উঠেছে নিবিড় ঐক্য। ধর্ম, জাতি ও সমস্ত ভেদাভেদের সংকীর্ণ গণ্ডীর উর্দ্ধে উঠে বাউলরা অখন্ড মানবতার আদর্শ প্রচার করেছে। উপলব্ধি করেছে জীবনের পরম সত্য চিরকালের মানুষকে। বাউল সঙ্গীতের এই সামাজিক আবেদন সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর খুব সুন্দর মন্তব্য করেছেন  -

"আমাদের দেশের ইতিহাস আজ পর্যন্ত প্রয়োজন এর মধ্যে নয়। পরন্তু মানুষের অন্তরতর গভীর সত্যের মধ্যে মিলনের সাধনাকে বহন করে এসেছে। বাউল সাহিত্য বাউল সম্প্রদায়ের সেই সাধনা দেখি, - এ জিনিস হিন্দু-মুসলমান উভয়েরই, একত্র হয়েছে অথচ কেউ কাউকে আঘাত করেনি। এই মিলনে সভা-সমিতির প্রতিষ্ঠা হয়নি, গান জেগেছে ও সেই গানের ভাষা ও সুর শিক্ষিত মাধুর্যে সরস। এই গানের ভাষায় ও সুরে হিন্দু-মুসলমানের কণ্ঠ মিলেছে, কোরাণে পুরাণে ঝগড়া বাঁধেনি।...... বাংলাদেশের গ্রামের গভীর চিত্রে উচ্চ সভ্যতার প্রেরণা স্কুল-কলেজের অগোচরে আপনা আপনি কি রকম কাজ করে এসেছে, হিন্দু মুসলমানের জন্য এক আসন রচনার চেষ্টা করেছে, এই বাউল গানে তারই পরিচয় পাওয়া যায়।"

শাক্ত পদকর্তাদের মত বাউলরা উদার মানবিক ধর্মের প্রচারক। তারা প্রেমের উপাসক। প্রেমময়-কল্যাণময়-আনন্দময় মনের মানুষের সঙ্গে তারা মিলন প্রয়াসী।
আল্লাহ ঈশ্বরের মধ্যে কোন ভেদাভেদ নেই, রাম রহিমের মধ্যে কোনো ভেদ নেই। সব মানুষই ঈশ্বরের সন্তান। ধর্মভেদ, জাতিভেদ, বর্ণভেদ - সবই কৃত্রিম। সব মানুষই এক।সব মানুষের মধ্যে পরমার্থ রয়েছে। এই শুদ্ধসত্ত্ব জীবনবোধে উদ্বুদ্ধ হলে জাতি বর্ণ ধর্মসম্প্রদায় নির্বিশেষে সকল মানুষের সমবায়ে গঠিত হবে নতুন সমাজ - যেখানে পারস্পরিক  প্রীতি,মমত্ববোধ ও দায়িত্ব চেতনায় মানুষ সংঘবদ্ধ হবে। মনুষ্যত্বের পবিত্র আদর্শে সকল মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রয়াসে বাউলরা উচ্চশ্রেণীর সাধক এবং ঐক্যমূলক ভারতীয় সভ্যতার বার্তাবাহী। অষ্টাদশ শতাব্দীতে দুর্গতির পঙ্ককুন্ডে নিমজ্জিত ও বিপর্যস্ত বিভ্রান্ত সামাজিক পটভূমিতে বাউলরা উদার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে শাশ্বত মানব ধর্মের বাণী উদারকন্ঠে ঘোষণা করেছেন।



মহত্মা লালন ফকির  ও  তার জীবন দর্শন -


পশ্চিমবাংলার বীরভূম জেলা হিন্দু বাউলের পিঠস্থান,আর অধুনা বাংলাদেশর কুষ্টিয়া, মুসলমান বাউলদের সাধনাকেন্দ্র। বাউল সাধকদের বিশেষত্ব প্রাচীনদের প্রামাণিক জীবন কথা জানার উপায় নেই। বাউল সংগীতকারদের মধ্যে লালন ফকির, পাঞ্জ শাহ্ মদন বাউলের নাম সুবিখ্যাত। লালন ফকিরের জীবনী সম্পর্কে প্রামাণিক তথ্য বিশেষ কিছু জানা যায়নি।আনুমানিক 1775 খ্রিস্টাব্দে নদীয়ার অন্তর্গত কুষ্টিয়ার কুমারখালী গ্রামের নিকট ভাঁড়ারা গ্রামে তাঁর জন্ম। বিবাহের পর তীর্থযাত্রায় বেরিয়ে পথি মধ্যে নিদারুণ  বসন্তরোগে আক্রান্ত হন এবং সঙ্গী-সাথী কর্তৃক পরিত্যক্ত হন। সিরাজ সাঁই নামক জনৈক মুসলিম দরবেশ মুমূর্ষ লালনকে সেবা-শুশ্রূষা করেন। তারই কৃপায়   লালনের প্রাণ রক্ষা হয়। দেশে ফিরলে হিন্দু সমাজ তাকে গ্রহণ করতে অস্বীকার করে। পরন্তু তার উপর নানা রকম অত্যাচার নির্যাতন চালায়। মুসলমানের গৃহে তার চিকিৎসা ও সেবা হয়েছিল বলে রক্ষণশীল গোঁড়া হিন্দু সমাজ তার প্রবেশদ্বার রুদ্ধ করে দেয়। তার হিন্দু স্ত্রীও তাকে গ্রহণ করতে অস্বীকৃত হন। তখন বাধ্য হয়ে লালন সিরাজের নিকট ফকিরী ধর্মের দীক্ষা নেন এবং এক মুসলমান রমনীকে পুনরায় বিবাহ করেন। তিনি হিন্দু ধর্মের বহু তীর্থ ভ্রমণ করে সকল ধর্মের সারতত্ত্ব অনুধাবন করতে প্রয়াসী হন। 
সিরাজ সাঁই ছিলেন লালনের দীক্ষা গুরু।লালন গুরুর কাছে সাধন পথে সিদ্ধিলাভের যে নির্দেশ পান, তা তিনি জনসাধারণের মধ্যে প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন। লালন হিন্দুর কুল ও সমাজ পরিত্যাগ করে ফকিরী ধর্মে দীক্ষা নেন। তাই কুলত্যাগী হওয়ার ফলেই লালন উদার উন্নত মানব ধর্মের প্রশস্ত রাজপথে  জীবনের মহাসংগীত রচনা করেন। হিন্দু-মুসলমান উভয় শ্রেণীর বহু মানুষ তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। কুষ্টিয়ার অনতিদূরে কালীগঙ্গার ধারে সেওরিয়া গ্রামে তার আখড়া ছিল। সেখানে তিনি সস্ত্রীক বাস করতেন। কোন বিশেষ সম্প্রদায়িক ধর্ম মানতে না। মানুষের ধর্মই ( The Religion of Man ) ছিল তাঁর ধর্ম। সকল ধর্মের লোকই তাকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করত। প্রতি বছর তিনি একটি প্রীতি উৎসব করতেন। এতে সকল শিষ্যপ্রশিষ্য যোগদান করত। সুদীর্ঘ ১১৬ বছরের জীবনে অজস্র বাউল গান রচনা করেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে লালন তার বাউল গানগুলি রচনা করেন। সুতরাং লালনের প্রতিভার বিকাশ ঊনবিংশ শতাব্দীতে। সে দিক থেকে লালনকে ঠিক মধ্যযুগের কবি বলা যায়না। আনুমানিক ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে  তিনি মারা যান। 

লালনের স্বহস্তে লিখিত কোন গানের খাতা বা পুঁথি পাওয়া যায়নি। আশ্রমের শিষ্যগণ গুরুর মুখনিঃসৃত গান খাতায় টুকে  রাখতেন। রবীন্দ্রনাথ গানগুলি কিছু কিছু তার এক কর্মচারীর দ্বারা নকল করিয়ে নেন। পরে ডক্টর মতিলাল দাস ও ডক্টর উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য লালনের গান নকল করেন। এ পর্যন্ত লালনের সাড়ে চারশোরও বেশি পদ মুদ্রিত হয়েছে। 
লালনের গানে সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদশূন্য চিরশুভ্র উদার মানবতার আদর্শ ধ্বনিত।হিন্দু সমাজ কর্তৃক নিগৃহীত হয়েছিলেন বলে অনেক গানে ব্যক্তিগত জীবনের প্রতিফলন ঘটেছে।
'সব লোকে কয় লালন কি জাত অন্তরে।' সীমা-অসীম,জীবাত্মা-পরমাত্মা ও মানবত্ব সম্পর্কে তিনি গভীর কথা শুনিয়েছেন। বাউল ধর্মের ধর্মকথা প্রকাশ করতে গিয়ে লালন ফকির সুফি সম্প্রদায়ের সাধন-ভজন সংক্রান্ত মুসলিম পারিবারিক শব্দ ও কোরানের তত্ত্বকথা অনেক ব্যবহার করেছেন। বৈষ্ণবিয় প্রতিকীও এসে গেছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে। রাধাকৃষ্ণের যুগলরূপ ও  চৈতন্যবাদের বন্দনা করে আধ্যাত্মভাবের পদ রচনা করেছেন। আবার হিন্দুর যোগতন্ত্রাদি থেকে সাধন প্রক্রিয়ার ধারাও অনুসরণ করেছেন। কিন্তু সবই মনের ভাবকে পরিস্ফুট করার একটা উপায় মাত্র। সরল প্রাঞ্জল ভাষায় উপমা ও রূপক প্রয়োগের অনুপম ব্যঞ্জনায় গভীর ভক্তি ও গীতিমূর্চ্ছনায় লালন বাউল সাধনার গূঢ় আধ্যাত্বিক তত্ত্বের ইঙ্গিত দিয়েছেন। সেই তত্ত্বের গভীরে পাঠক প্রবেশ করুক বা না করুক তার ভাবমাধুর্যে সবাই মুগ্ধ হয়। তত্ত্বকথা তাঁর কাব্যে বিচিত্র রসসৌন্দর্যে লীলায়িত হয়ে উঠেছে। মনের মানুষের সন্ধানেই লালন একতারা হাতে নিয়ে গান করতে করতে পথ হেঁটেছেন। -


"বল কি সন্ধানে যাই সেখানে মনের মানুষ যেখানে।

(ওরে ) আঁধার ঘরে জ্বলছে বাতি দিবারাতি নাই সেখানে।।
কত ধনীর ভরা যাচ্ছে মারা পড়ে নদীর ভোড় তুফানে।
ভবে রসিক যারা পার হয় তারা তারাই নদীর ধারা ধারা চিনে।।" 

বাউলতত্ত্বে নারীদেহকেন্দ্রিক সাধনার প্রক্রিয়া লালনের গানে চমৎকারভাবে কাব্যরসে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে  -


"চেয়ে দেখ নারে মন দিব্য নজরে।

চারি চাঁদ দিচ্ছে ঝলক মনিকোঠার ঘরে ।। হলে সে চাঁদের সাধন
অধর চাঁদ হয় দরশন
আবার চাঁদেতে চাঁদের আসন রেখেছে ঘিরে।"


রসিক বাউলরা জীবনের সুখ-দুঃখের দিবারাত্রির উর্দ্ধস্তরে নির্বিকল্প জগতে পারমার্থের সাক্ষাৎ পান। কালপ্রবাহের প্রচন্ড আঘাতে কত বিত্তবান ঐশ্বর্যতরণী নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু বাউলরা জন্ম-মৃত্যু,সুখ-দুঃখের অতীত নিত্যজোতির্ময় আলোকোজ্জ্বল অধিবাসী। মনের মানুষকে জেনেছেন বলেই লালনের কাছে সাধন,পূজন,ভজন,আরাধনা,দেবদেবী ও শাস্ত্রগ্রন্থ সবই অর্থহীন।


"মানুষ তত্ত্ব যার সত্য হয় মন 

সে কি অন্য তত্ত্ব মানে।
মাটির ঢিপি কাঠের ছবি -
ভূত ভাবি সব দেব আর দেবী
ভোলে না সে এসব রূপে
ও যে মনের রতন চেনে।"


লালনের মতে এই রতনকে চেনাই জীবনের সারকথা। 'আপনাকে আপনি চেনা / সেই বটে উপাসনা।' 
আপনাকে আপনি না চিনলে 'লালন বলে, অন্তিমকালে নাইরে উপায় '। চিনি খেতে হলে অন্তরের মধ্যে সেই ভান্ডারের সন্ধানে ব্যাপৃত থাকতে হবে। -

"ঘর ছেড়ে ধন বাইরে খোঁজা বয় সে যেমন চিনির বেনঝা
পায় না রে সে চিনির মজা
বলদ যেন ছাই।"

দেহের মধ্যে অমৃত রয়েছে। যা আছে ব্রহ্মাণ্ডে তা আছে দেহভান্ড।মানুষের দেহস্থিত অরূপ রতন পুরুষকে লালন পাচীন পাখিও বলেছেন। একটি বিখ্যাত গানে পাই  -


"খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আইসে যায়,

( আমি ) ধরতে পারলে মনো বেড়ি দিতাম পাখির পায়।
চিরকালটা পুষলেম পাখি
 বুঝলাম না তার ফাঁকি-জুকি 
দুধ কলা দিযই খায়রে পাখি তবু ভোলে  না তায়।"

এই আধ্যাত্মিক তত্ত্ব প্রকাশ করতে গিয়ে লালন ফকির মানুষকে সর্বপ্রকার ক্ষুদ্রতা,তুচ্ছতা ও সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে মুক্ত ও শুদ্ধতত্ত্ব পূর্ণস্বরূপে উদ্ভাসিত করে তুলেছেন -


"সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে।

 লালন বলে জাতের কি রূপ দ্যাখলাম না এই নজরে।।
 যদি খতরা নিলে হয় মুসলমান।
নারীর তরে কি হয় বিধান।।
বামুন চিনি পৈতা প্রমাণ।
বামনী চিনি কিসেরে।।"

লালনের গানে অধ্যাত্ম আদর্শ রয়েছে কিন্তু তাঁর বলিষ্ঠ ভক্তি মানুষকেই বেশি মূল্য দিয়েছে। আমরা জাত জাত করি - ছোট জাত-বড়ো জাত নিয়ে কত গর্ব,কত ঘৃণা কিন্তু  জাতের স্বরূপ কিছুই নেই। লালনের বক্তব্য মানুষের প্রকৃত পরিচয় মানবতার আদর্শে।
সমাজ জীবনের উপেক্ষিত মানবতাকেই  তিনি আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। প্রীতির চোখে তিনি সর্বমানবের দিকে তাকিয়েছেন। তিনি বিদ্রোহ করেছেন প্রাণহীন শাস্ত্র সংহিতার বাণী ও সংকীর্ণ স্বার্থবুদ্ধির বিরুদ্ধে। সে বিদ্রোহ হচ্ছে - শ্রেয়বোধের বিদ্রোহ। লালনের কথা এই যে মানুষের হৃদয়েই পরম সত্য রয়েছে। তীর্থে, ব্রতে, আচারে,তিলকে,বর্ণে ও সাম্প্রদায়িকতায় সত্য নেই। প্রেমের পথই সত্য প্রাপ্তির পথ। রবীন্দ্রনাথ বাউল গান সম্পর্কে শিক্ষিত সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। লালনের গান রবীন্দ্রনাথকে বিশেষভাবে মুগ্ধ করে। বহু গ্রন্থে বহু প্রসঙ্গে লালনের গান উদ্ধৃত করে রবীন্দ্রনাথই তার সুনদর আলোচনা করেছেন। সংস্কারমুক্ত উদার সর্বমানবিক আদর্শ কবিকে একান্তভাবে আকৃষ্ট ও মুগ্ধ করেছিল। লালন আমাদের নিত্য ব্যবহৃত আটপৌরে ভাষায় অতি পরিচিত উপমা ও সংকেতের সাহায্যে বাউল সাধন তত্ত্বকে প্রকাশ করেছেন। 

সেই সাধন তত্ত্বের সার কথা হল -


"ও গৌরের প্রেম রাখিতে সামান্য কি পারবি তোরা।

কুলশীল ত্যাগ করিয়া হতে হবে জ্যান্তে মরা।।" 


চলতি ভাষাকে সাধন কবি লালন উচ্চতর ভাবপ্রকাশের মর্যাদায় ও সাহিত্যিক সৌন্দর্যে উন্নীত করার জন্য রবীন্দ্রনাথ তাঁর  ভূয়সী প্রশংসা করেছেন -
"প্রাকৃত বাংলার সুয়োরানীকে যারা দুয়োরানীর প্রভাবে সাহিত্যের গোয়ালঘরে স্থান না দিয়ে হৃদয়ে স্থান দিয়েছে সেই অশিক্ষিত লাঞ্ছনাধারির দল যথার্থ বাংলা ভাষার সম্পদ নিয়ে আনন্দ করতে বাধা পান না। 
রবীন্দ্রনাথকে বিশেষভাবে মুগ্ধ করেছিল লালনের মানবিকতাবোধ। মানবতন্ত্রী কবি রবীন্দ্রনাথ অক্সফোর্ড বক্তৃতায় লালনকে উপনিষদের ঋষির সঙ্গে তুলনা করেছেন।

বাস্তবিকই মানবতার আদর্শপ্রচারে লালন এক মহৎপ্রাণ ধর্মসাধক। বিভিন্ন জাতি ধর্ম সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্যপ্রতিষ্ঠার বাণী তাঁর সংগীতগুলিকে অসামান্য মর্যাদা দিয়েছে। লালন রাজা রামমোহন রায়ের সমসাময়িক।রামমোহন ভারতপথিক। মিলনের সত্য সকল মানুষের চরমসত্য। ভারতীয় সভ্যতার বৈশিষ্ট্য বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যসাধনকে তিনি বড় করে দেখেছিলেন। অনুরূপভাবে লালন ফকিরের সংগীতে মনুষ্যত্বের নিবিড়  আত্মীয়তার মধ্যে সব মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করার রাগিণী বেজে উঠেছে। লালন তাঁর সঙ্গীতের সাহায্যে পল্লীর অল্পশিক্ষিত, অশিক্ষিত মানুষের মধ্যে বিপুল জাগরন সৃষ্টি করেন। 
রবীন্দ্রনাথ যথার্থই বলেছেন - "এই ভারতের একজাতীয়তা রেখেছে শুধু ফকিরেরাই।" আর লালনের ক্ষেত্রেই এই উক্তি সার্থকভাবে প্রযোজ্য। বাংলার লোকসংস্কৃতির অন্যতম  স্রষ্টা লালন প্রকৃতপক্ষে একজন   "Prophet of humanity."


ধন্যবাদ -

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ