চন্ডীমঙ্গল কাব্য : চন্ডীমঙ্গল কাব্য কাকে বলে? চন্ডী মঙ্গল কাব্যের কাহিনী, প্রধান চরিত্র এবং শ্রেষ্ঠ্য কবিগণের পরিচয়


চন্ডীমঙ্গল কাব্য : চন্ডীমঙ্গল কাব্য কাকে বলে? চন্ডী মঙ্গল কাব্যের কাহিনী, প্রধান চরিত্র এবং শ্রেষ্ঠ্য কবিগণের পরিচয় :

চন্ডীদেবীর লীলা মাহাত্ম্য নিয়ে রচিত আখ্যান কাব্যকেই চন্ডীমঙ্গল কাব্য বলা হয়।


Ma Chandi
Ma Chandi


চন্ডীমঙ্গল কাব্যের দুটি খন্ড আছে। একটি হল 'আখেটিক খন্ড' - যেখানে কালকেতু ও ফুল্লরা কাহিনী আছে।
দ্বিতীয়টি হল 'বণিক খন্ড ' -  যেখানে ধনপতি ও শ্রীমন্ত সদাগরের কাহিনী আছে।


আখেটিক খন্ড

দেবী চণ্ডী মর্ত্যে পূজা প্রচারের উদ্দেশ্যে সুকৌশলে মহাদেবকে দিয়ে নীলাম্বর কে অভিশাপগ্রস্ত করে মর্তলোকে পাঠালেন। অভিশপ্ত নীলাম্বর ব্যাধের ঘরে কালকেতু নাম দিয়ে জন্ম গ্রহন করল। নীলাম্বরের স্ত্রী ছায়াও স্বর্গভ্রষ্ট হয়ে ব্যাধ কন্যা ফুল্লরা রুপে জন্মগ্রহণ করল। বয়প্রাপ্ত হলে কালকেতু বনে বনে পশু শিকার করে আর সেই পশুর মাংস ফুল্লরা হাটে হাটে বিক্রি করে। একদিন বনের পশুরা কালকেতুর অত্যাচারে জর্জরিত হয়ে দেবী চণ্ডীর আরাধনা করে। দেব চন্ডী তাদের দুর্গতি মোচনের আশ্বাস দেন। তিনি একটি স্বর্ণ গোধিকার রূপ ধারণ করে কালকেতুর বন গমনের পথে শুয়ে রইলেন। কালকেতু  সেই স্বর্ণ গোধিকাটিকে নিজের ধনুকের ছিলায় বেঁধে নিলেন। দেবীর মায়ায় সেদিন কালকেতু অরণ্যের মধ্যে কোন পশু দেখতে পেলে না। বাড়ি ফিরে এসে স্বর্ণগোধিকাটিকে দাওয়াই রেখে কালকেতু গোলাহাটে গেল বাসী মাংস বিক্রি করতে। আর ফুল্লোরা গেল সখীর কাছে খুদ ধার করতে। বাড়ি ফিরে এসে ফুল্লরা দেখল এক সুন্দরী রমনী ঘর আলো করে বসে আছে। ফুল্লরা ভাবল তার স্বামী এই সুন্দরী রমণীকে বিবাহ করে নিয়ে এসেছে। সেই নারীকে বিতাড়িত করার জন্য ফুল্লোরা তার বার মাসের দুঃখের কথা বর্ণনা করেছে। কিন্তু সেই নারী কিছুতেই সেই গৃহ পরিত্যাগ  করতে চাইলো না। তখন অভিমান ক্ষুব্ধ ফুল্লরা হাট থেকে কালকেতুকে ডেকে এনেছে। বিস্মিত কালকেতু বাড়ি ফিরে এসে সেই রমণীকে বাড়ি ছেড়ে চলে যাবার জন্য অনুরোধ করেছে। কিন্তু তিনি রাজি না হওয়ায় ক্ষুব্দ কালকেতু তার দিকে শর নিক্ষেপ করতে উদ্যত হলে দেবী চণ্ডী নিজ মূর্তি ধারণ করেছেন এবং কালকেতুকে সাত ঘড়া ধন এবং একটি বহুমূল্য অঙ্গুরীয় দান করে দেন। তিনি কালকেতুকে বন কেটে গুজরাট নগর পত্তন  করতে এবং মন্দির স্থাপন করে তার প্রজা প্রচার করতে নির্দেশ দিলেন।
অঙ্গুরীয় বিক্রি করার জন্য কালকেতু যায় বণিক মুরারি শীলের কাছে। মুরারি ছিল ধূর্ত বণিক সে কালকেতুকে ঠকাবার চেষ্টা করে কিন্তু দৈববাণী হওয়াই ভীত মুরারি অঙ্গুরীর প্রকৃত মূল্য দিতে বাধ্য হয়।এরপর কালকেতু বন কেটে গুজরাট নগর পত্তন করেন। নানা দেশ থেকে বহু লোক এসে সেখানে বসবাস শুরু করে। ভাঁড়ু দত্ত নামে এক ব্যক্তি কালকেতুকে হাত করে প্রজাদের উপর নানা উপায়ে অত্যাচার করতে শুরু করে। কালকেতু এ কথা জানতে পেরে ভাড়ু দত্তকে রাজ্য থেকে বিতাড়িত করে।ভাঁড়ুদত্ত এই অপমানের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য কলিঙ্গরাজকে কালকেতুর বিরুদ্ধে উত্তেজিত করে। কলিঙ্গরাজ কালকেতুর রাজ্য আক্রমণ করে এবং কালকেতুকে বন্দি করে কারাগারে নিক্ষেপ করে। বন্দী কালকেতু তখন দেবী চণ্ডীর উদ্দেশ্যে চৌতিশা স্তব শুরু করে। দেব চণ্ডীর আদেশে কলিঙ্গরাজ কালকেতুকে মুক্তি দেন।কালকেতু গুজরাট নগরে ফিরে আসে এবং ভাঁড়ুদত্ত কে শাস্তি দেয়। এরপর দীর্ঘকাল রাজত্ব করে স্বর্গলোক গমন করে।



বণিক খন্ড

দেবী চণ্ডী বণিক শ্রেষ্ঠ ধনপতি সদাগরকে দিয়ে মর্ত্যভূমিতে নিজ পূজা প্রচার করতে চাইলেন। স্বর্গের নর্তকীর নৃত্যকালে সামান্য তালভঙ্গ হওয়ায় আভিশাপগ্রস্ত হয়ে মর্ত্যলোকে খুল্লনা নামে জন্মগ্রহণ করে। ধনপতি সদাগরের প্রথমা স্ত্রী লহমা থাকা সত্ত্বেও খুল্লনার রূপে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে বিবাহ করেন। কিছুদিন পরে বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে বিদেশে গমন করলে দুর্বলা নামে এক দাসীর প্ররোচনায় খুল্লনার উপর অত্যাচার শুরু করে। খুল্লনা বনে বনে ছাগল চরাতে শুরু করল, রাত্রিবেলায় ঢেঁকিশালায় শুতে লাগল। কিন্তু এর মধ্যেই অরণ্যের মধ্যে রাখাল বালকদের কাছ থেকে চন্ডিপূজা শিখে নিল এবং মঙ্গলচন্ডীর ব্রত অনুষ্ঠান করতে লাগল। বাণিজ্য থেকে ফিরে এসে ধনপতি সবকিছু জানতে পারলেন এবং লহনাকে ভীষণভাবে ভৎসনা করলেন। এরপর খুল্লনা যখন গর্ভবতী তখন ধনপতি আর একবার বাণিজ্য যাত্রায় বহির্গত হলেন। খুলনা স্বামীর মঙ্গলকামনায় মঙ্গলচন্ডীর ঘট স্থাপন করে যখন পূজা করেছিলেন তখন ধনপতি সেই ঘরে প্রবেশ করে পদাঘাতে ঘট ভেঙে দিলেন। চন্ডী ধনপতির উপর ক্ষুব্ধ হলেন এবং কালিদহে দেবীর মায়ায় 'কমলে কামিনী' দৃশ্য দেখলেন। দেখলেন পথের উপর উপবিষ্টা এক নারী একবার হস্তী গিলে ফেলছেন এবং পরমুহূর্তে উগরে ফেলছেন।

সিংহলে উপনীত হয়ে ধনপতি সিংহল রাজকে কমলে কামিনীর কথা বললে সিংহল রাজ তা বিশ্বাস করলেন না। তখন তিনি সিংহল রাজকে কালিদহে নিয়ে গেলেন কিন্তু কমলে কামিনী দৃশ্য দেখাতে পারলেন না। সিংহল রাজ তাকে কারাগারে নিক্ষেপ করলেন। এদিকে স্বর্গভ্রষ্ট মালাধর খুল্লনার গর্ভজাত সন্তান হিসেবে জন্ম গ্রহণ করলেন। তার নাম হল শ্রীমন্ত। শ্রীমন্ত বড় হয়ে নিরুর্দ্দিষ্ট পিতার সন্ধানে সমুদ্রযাত্রায় বের হল। সেও যথারীতি পিতার মত কালিদহে কমলে কামিনী দেখল এবং সিংহল রাজকে তা বললো কিন্তু সেও সিংহল রাজকে কালিদহে ঐ দৃশ্য দেখাতে পারল না। ফলে সিংহল রাজ তাকেও বন্দি করে কারাগারে রাখল। সেখানে পিতা পুত্রের মিলন হল। এবার তারা দুজনেই দেবী চণ্ডীর স্তব করতে লাগলেন। তখন দেবী সন্তুষ্ট হয়ে' সিংহল রাজকে স্বপ্নে নির্দেশ দিলেন পিতা পুত্র মুক্ত করতে। দেবীর নির্দেশ পেয়ে সিংহল রাজ্য উভয়কেই মুক্তি দিলেন এবং নিজ কন্যা সুশীলার সঙ্গে শ্রীমন্তের বিয়ে দিলেন। ধনপতি - পুত্র,পুত্রবধূ নিয়ে দেশে ফিরলেন এবং মহাসমারোহে দেবী চণ্ডীর পূজো করলেন। মর্ত্যলোকে দেবীর পূজা প্রচলিত হলো।


চন্ডীমঙ্গল কাব্যের  শ্রেষ্ঠ কবিগণ 🔹


চন্ডীমঙ্গল কাব্যের আদি কবি হলেন মানিক দত্ত। পরবর্তীকালের কবি মুকুন্দরাম, মানিক দত্তের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে লিখেছেন -

"মানিক দত্তরে আমি করিনু বিনয়।
 যাহা হৈতে হৈল গীত পথ পরিচয়।।"

মানিক দত্তের পুঁথি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু এই পুঁথির প্রাচীনত্ব সম্পর্কে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। কারণ এর ভাষা খুব প্রাচীন নয় তাছাড়া তার পুঁথিতে চৈতন্যদেব ও তার অনুচরদের বিস্তৃত বর্ণনা আছে। আছে বহু ফিরিঙ্গী এবং হার্মাদদের ব্যবহৃত শব্দ। মনে হয় এই কাব্যের বহু অংশ প্রক্ষিপ্ত।গায়েনদের পুনঃ পুনঃ হস্তক্ষেপের ফলে পুঁথির ভাষা যেমন পরিবর্তিত হয়েছে তেমনি পরবর্তীকালের বহু ঘটনাও  প্রবিষ্ট হয়েছে।

কবি যে আত্ম পরিচয় দিয়েছেন তা থেকে জানা যায় যে তিনি মালদহ জেলার ফুলিয়া নগরের ( ফুলবাড়ী ) অধিবাসী ছিলেন। তাঁর কাব্যে মালদহ জেলার বহু জনপদ এর উল্লেখ আছে। কবি ছিলেন কানা এবং খোঁড়া। কিন্তু দেবীর কৃপায় তিনি পঙ্গুত্বের হাত থেকে মুক্তি লাভ করেন এবং গানের দল নিয়ে তিনি দেবীর মাহাত্ম্য প্রচার করেন। তাঁর কাব্যে বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব আছে। তিনি যে সৃষ্টিতত্ত্বের বর্ণনা দিয়েছেন তাতে দেখা যায় ধর্ম নিরঞ্জন প্রথমে আদ্যাশক্তিকে সৃষ্টি করলেন - এই আদ্যাশক্তিই পরে চণ্ডীতে রূপান্তরিত হলেন। তারপর তিনি সৃষ্টি করলেন ব্রহ্মা,বিষ্ণু,মহেশ্বরকে। ধর্মের নির্দেশে মহেশ্বর চন্ডীকে বিবাহ করলেন। এরপর আরম্ভ হল পৌরাণিক হর - পার্বতীর কাহিনী।
সৃষ্টিতত্ত্বের বর্ণনা এবং পৌরাণিক কাহিনীর তুলনায় তার কাব্যে কালকেতু এবং ধনপতির আখ্যান খুব সংক্ষিপ্ত। কাহিনী বিন্যাসে, চরিত্র সৃষ্টিতে তিনি কোন দক্ষতা দেখাতে পারেননি। তাঁর কাব্যের সাহিত্য- গুণও অতি সামান্য। তবে চন্ডীমঙ্গল কাব্যের আদি কবি হিসাবে তার একটা আলাদা মর্যাদা অবশ্যই আছে।

◼ দ্বিজমাধব ◼

চন্ডীমঙ্গল কাব্যের অন্যতম প্রধান কবি হলেন দ্বিজ মাধব বা মাধবাচার্য। তার কাব্যের নাম 'সারদামঙ্গল' বা 'সারোদাচরিত'। তিনি যে আত্মপরিচয় দিয়েছেন তা থেকে জানা যায় তার পিতার নাম পরাশর এবং জন্মস্থান ত্রিবেনীর নিকটে সপ্তগ্রাম। তিনি লিখেছেন -

"ত্রিবেণীতে গঙ্গাদেবী ত্রিধারে বহে জল।
 সেই মহানদী তটবাসী পরাশর।
.........................................................
তাহার তনুজ আমি মাধব আচার্য।"



তবে তার কাব্য যেহেতু চট্টগ্রাম অঞ্চলে আবিষ্কৃত হয়েছে সেহেতু অনেকে তাকে চট্টগ্রামের অধিবাসী বলে মনে করেন। তবে এ মত গ্রহণযোগ্য নয়। মনে হয় কোন সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় বিশৃঙ্খলার কারণে তিনি সপ্তগ্রাম পরিত্যাগ করে পূর্ববঙ্গে চট্টগ্রাম অঞ্চলে বসবাস শুরু করেন। কবি তার কাব্যের রচনাকাল সম্পর্ক বলেছেন -

"ইন্দু-বিন্দু বাণ শক  নিয়োজিত।
দ্বিজমাধব গায় সারদা চরিত।।"

ইন্দু= ১, বিন্দু = ০, বাণ = ৫, ধাতা = ১। বিপরীত দিক থেকে গণনা করলে দাঁড়ায় ১৫০১ শকাব্দ অর্থাৎ ( ১৫০১+৭৮ ) খ্রিস্টাব্দ। কবি তার কাব্যের 'দেবখন্ডে' একটি নতুন কাহিনী বর্ণনা করেছেন। সেখানে দেখানো হয়েছে দেবী চন্ডী, মঙ্গল নামে এক অসুরকে বধ করেছেন। তাই কাব্যে কোথাও কোথাও তাকে 'মঙ্গলচণ্ডী' বলা হয়েছে। 'মঙ্গল দৈত্য' বধি মাতা হইল মঙ্গলচন্ডী।' কাব্যটি 'মঙ্গলচন্ডীর' গীত নামে পরিচিত। চট্টগ্রাম অঞ্চলে কাব্যটি জাগরন নামেও পরিচিত। যেহেতু আটদিন ধরে রাত জেগে লোকে এই গান শুনতো তাই এই নাম।
দ্বিজমাধব ছিলেন বস্তুনিষ্ঠ কবি। বাস্তবতার বর্ণনায় তিনি অসাধারণ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। যখন তিনি ব্যাধ জীবনের কাহিনী বর্ণনা করেছেন তখন তিনি অতি তুচ্ছাতিতুচ্ছ বস্তুকেও বাদ দেননি। কালকেতুর গৃহ বর্ণনা করার সময় ভেরান্ডার থাম, কুঁড়েঘর,ছেঁড়া কাঁথা, বাসী মাংসের পসরা, দুর্গন্ধযুক্ত পরিধেয় বস্ত্র কোন কিছুই তার দৃষ্টি এড়ায়নি। আচার্য দীনেশচন্দ্র সেন বলেছেন -
"মাধু ( দ্বিজ মাধব ) ভেরান্ডার থাম ধরিয়া ব্যাধের ঘরে উঁকি মারিয়া নিজে এই সকল দেখিয়েছেন......ভদ্র কবি গ্রাম্য ফটো তুলিয়া লইয়াছেন। তাহা মার্জিত করিয়া সুন্দর করিতে চান নাই।"

আসলে দ্বিজমাধব কল্পনার জগতে বিচরণ করতে চাননি। তিনি যা দেখেছেন তারই হুবহু প্রতিচ্ছবি এঁকেছেন। কালকেতুর শৈশব কাহিনীর বর্ণনাতেও বাস্তবতার নিখুঁত চিত্র অঙ্কিত হয়েছে -

"বাটুল লয়ে করে           পশুপক্ষী চাপি ধরে
              কাহার  ঘরেতে নাহি চায়।
কুঞ্চিত করিয়া আঁখি       থাকিয়া মারয়ে                  পাখি  ঘুরিয়া ঘুরিয়া পড়িয়া যায়।।"

বণিক খন্ডতেও দেখা যায়  খুঁটিনাটি বর্ণনার দিকে কবির ঝোঁক। ধনপতির অনুপস্থিতিতে লহনা নানাভাবে খুল্লনাকে নির্যাতন করেছিল। সেই নির্যাতনের ছবি তুলে ধরেছেন এইভাবে -

"অল্প অন্ন দিল ছেছা পোড়া বহুল।
পাট শাক রাঁধি দিল পাকা কলার মূল।।
ভাঙ্গা নারিকেল জল দিল সুবদনী।
ভোজন করিতে বৈসে খুল্লনা বাধ্যানী।।"

ঘটনার অবিকল আলেখ্য এই ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন কবি। চরিত্র-চিত্রনেও দ্বিজমাধব কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। বিশেষভাবে কালকেতু এবং ভাঁড়ুদত্তের চরিত্র নির্মাণে তার দক্ষতা অবশ্যই প্রশংসনীয়। কালকেতুর চরিত্রটিকে তিনি আগাগোড়া একটি বীর চরিত্র রূপেই অঙ্কন করেছেন। কলিঙ্গরাজ অসংখ্য সৈন্য নিয়ে কালকেতুর রাজ্য আক্রমণ করলে ভীত সন্ত্রস্ত ফুল্লরা কালকেতুকে আত্মগোপন করতে বলে। আর তখনই বীরধর্মের উদ্দীপিত কালকেতু প্রচন্ড গর্জন করে উঠেছে, ক্রোধে তার সমস্ত শরীর কম্পিত হয়েছে :

"শুনিয়া যে বীরবর ক্রোধে কাঁপে থরথর
শুন রামা আমার উত্তর।
করে লৈয়া শর গান্ডী পূজিব মঙ্গল চন্ডী
বলি দিব কলিঙ্গ ঈশ্বর।।"

বন্দী হয়ে কলিঙ্গ রাজসভায় এসেও সে তার বীর ধর্মকে হারিয়ে ফেলেনি।
'রাজসভা দেখি বীর প্রণাম না করে।'
তার অঙ্কিত ভাড়ুদত্তের চরিত্রটি সজীব এবং উপভোগ্য। ভন্ডামীতে ভাঁড়ুর তুলনা পাওয়া ভার। শঠতা এবং প্রবঞ্চনা করে সে সংসার চালায়।

স্ত্রী বচনে ভাঁড়ু ভাবে মনে মন।
আজিকার অন্ন আমার মিলিব কেমন।। 
ভাঙ্গা কড়ি,ছয় বড়ি গামছা বাঁধিয়া।
ছাওয়ালের মাথায় বোঝা দিলেক তুলিয়া।। কড়ি বুড়ি নাই ভাঁড়ুর বাক্য মাত্র সার।
ত্বরায় পাইল গিয়া নগর বাজার।।

ভাঁড়ুর উদরে অন্ন জোটে না কিন্তু বিলাসী লোকের মতো তার পান খাওয়াটি চাই। তাই স্ত্রী গঞ্জনা দেয় 'উদরে না চিনে অন্ন, তাম্বুল পান মুখে।' এই ভাঁড়ু দত্ত একদিন হাটে গিয়ে গয়লা বুড়ির কাছ থেকে দই খেতে চাইল। বুড়ি জানত ভাঁড়ূ তাকে পয়সা দেবে না, তাই সে দই দিতে চাইল না। তখন ভাঁড়ু তাকে ভয় দেখায়  -

"চোরা গাই কিনিয়া বুড়ি তোমার বসত।
এ হার বাদী হইয়াছে গ্রামের রায়ত।।"

তখন ভাঁড়ূর কথায় বুড়ি ভয় পেল এবং তাকে বিনা পয়সায় দই দিতে বাধ্য হল। কালকেতুর বিরুদ্ধে কলিঙ্গরাজকে উত্তেজিত করার জন্য ভাঁড়ু বলেছিল -

"গোপনে সৃজিল পুরী গুজরাট নগরে।
ব্যাধের নন্দন হৈয়া ছত্র ধরে শিরে।।
তোমি নাহি গণে বেটা মদগর্বভরে।
ভূপতি সদৃশ্য বেটা জানে আপনারে।।"

অবশ্যই পড়ুন - ভালো থাকার মন্ত্র 


ভাঁড়ু শুধু ভন্ড নয়,সে নির্লজ্জও বটে। ভাঁড়ুর অপরাধের শাস্তি হিসাবে কালকেতু  তার মাথা মুড়িয়ে ঘোল ঢেলে গঙ্গাপার করিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু গঙ্গাপারে গিয়ে সে সেখানকার লোকজনদের বলেছিল মা গত হয়েছে বলে 'গঙ্গা পারগিয়া মুড়াইয়াছি মাথা।' দ্বিজমাধব কর্তৃক ভাঁড়ুদত্তের এহেন চরিত্র চিত্রন দেখে ডক্টর সুকুমার সেন মন্তব্য করেছেন, 'মাধব ভাঁড়ুদত্তকে একেবারে ভাঁড়  করিয়া আঁকিয়াছেন।

 🔹মুকুন্দরাম চক্রবর্তী 🔹

মুকুন্দরাম চক্রবর্তী শুধু চন্ডী মঙ্গলের শ্রেষ্ঠ কবি নন। মধ্যযুগের সমগ্র মঙ্গলকাব্য ধারায় তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ কবি। তাঁর রচিত চন্ডীমঙ্গল কাব্যের পাতায় পাতায় তাঁর অনন্যসাধারণ কবি প্রতিভার বহুবর্ণ দীপ্তি ছড়িয়ে আছে। তিনি তাঁর অসামান্য প্রতিভা বলে চন্ডীমঙ্গল কাব্যের মত অতি সাধারন কাহিনীকে একটি সার্থক রসোত্তীর্ণ কাব্যে পরিণত করতে সমর্থ হয়েছেন। পরিকল্পনার মৌলিকতায়, কাহিনী চিত্রণে, চরিত্র সৃষ্টিতে এবং কলা নৈপুণ্যের দিক দিয়ে তাঁর কাব্যটি মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে একটি স্বর্ণসৌধ বিশেষ। দেবতার মাহাত্ম্য কাহিনী বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি আসলে আমাদের সুখ-দুঃখ, বিরহ মিলন পূর্ণ সংসার জীবনের কথাই অপরিসীম মমতা সহকারে তুলে ধরেছেন। তিনি জীবন-রস রসিক কবি। ষোড়শ শতকে রচিত হয়েছে তার কাব্য। আধুনিককাল তখন বহু দূরে তবু তাঁর কাব্যে শোনা গেছে মানবতার বাণী। তার কাব্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মানবতার মর্যাদা।
কবি যে আত্মপরিচয় পরিচয় দিয়েছেন তা থেকে জানা যায় যে তার পৈতৃক নিবাস ছিল বর্ধমান জেলার দামুন্যা গ্রামে। কবির পিতামহের নাম জগন্নাথ মিশ্র, পিতা হৃদয় মিশ্র, বড় ভাইয়ের নাম কবিচন্দ্র এবং মায়ের নাম দৈবকি। 'কবিকঙ্কন' তাঁর উপাধি। কবিরা ছিলেন রাঢ়ী ব্রাহ্মণ। কৃষিকার্য ছিল তাদের জীবিকা। দামুন্যা তালুকদার গোপীনাথ নন্দার জমি চাষ করে কবির দিন কাটছিল শান্তিপূর্ণভাবে কিন্তু এই সময়ে রাজনৈতিক বিপর্যয় শুরু হয় দেখা দেয় অরাজকতা। সুযোগ বুঝে ডিহিদার মামুদ শরীফ নিরীহ প্রজাদের উপর অত্যাচার শুরু করে। তখন কবি সাত পুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে বেরিয়ে পড়েন। পথে দস্যু রূপ রায় তার সর্বস্ব কেড়ে নেয়। তখন যদু কুন্ডু নামে এক তেলি কবিকে আশ্রয় দেয়। তারপর বহু দুঃখ কষ্ট সহ্য করে মুড়াই, দারকেশ্বর, দামোদর নদী পার হয়ে কবি গোচারিয়া গ্রামে উপস্থিত হন। সেখানে -



"তৈল বিনা কৈলু স্নান করিলুঁ উদক পান
শিশু কিন্দে ওদানের তরে।"

স্নান সেরে শালুক পোড়া দিয়ে কবি গৃহদেবতার পূজা করলেন। পরিশ্রম এবং ক্ষুধায় কাতর হয়ে কবি ঘুমিয়ে পড়লেন। আর তখনই দেবী চণ্ডী স্বপ্নে আবির্ভূত হয়ে কাব্য রচনা করতে নির্দেশ দিলেন -

"মা কৈল পরম দয়া দিল চরণের ছায়া
আজ্ঞা দিল রচিতে কবিত্ব।"

এরপর কবি শিলাই নদী পার হয়ে ঘাটাল মহকুমার অন্তর্গত আড়রা গ্রামের ব্রাহ্মণ জমিদার বাঁকুড়া রায়ের গৃহে পৌঁছান। বাঁকুড়ায় তাকে আশ্রয় দেন এবং পুত্র রঘুনাথ রায়ের গৃহ শিক্ষক নিযুক্ত করেন।এই রঘুনাথ রায়ের অনুরোধেই কবি তাঁর কাব্য 'অভয়ামঙ্গল' রচনা করেন।


লোক সমাজে প্রচলিত কাহিনীকে অবলম্বন করে মুকুন্দ তার চন্ডীমঙ্গল কাব্য রচনা করেছিলেন। দেবখন্ডে হরপার্বতীর কাহিনী নরখন্ডে কালকেতু-ফুল্লরার কাহিনী এবং ধনপতি সওদাগরের কাহিনীকে তিনি একটি সুসংহত পূর্ণাঙ্গ রূপ দিয়েছেন। হরপার্বতীর কাহিনী দেব কাহিনী হলেও এর মধ্যে তিনি দরিদ্র দরিদ্র অভাব ক্লিষ্ট বাঙালি ঘরে ছবি এঁকেছেন। কালকেতুর কাহিনীতে সমাজের অন্ত্যজ শ্রেণীর মানুষের সীমাহীন দারিদ্রকে রূপায়িত করেছেন এবং বণিক খন্ডে সমাজের উচ্চবিত্ত পরিবারের দ্বন্দ্ব ও সমস্যাকে ফুটিয়ে তুলেছেন। মুকুন্দরাম জীবনকে খুব ঘনিষ্ঠভাবে দেখেছিলেন। তার বাস্তব অভিজ্ঞতা ছিল ব্যাপক। সেইজন্যই কালকেতুর গুজরাট নগর পত্তনকালে বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের পরিচয় প্রদানে এবং মুসলিম সমাজের চিত্র অঙ্কনে অসাধারণ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। ব্রাহ্মণ,অব্রাহ্মণ বৈশ্য,শূদ্র এবং মুসলমান সমন্বিত যে বৃহত্তর বাঙালি সমাজ - তার পূর্ণাঙ্গ চিত্রটি ফুটে উঠেছে তার কাব্যে।

ধন্যবাদ -

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ