আপনারা কি সবাই রোজ গায়ত্রী মন্ত্র জপ করুন? তবে জেনে নিন এর প্রকৃত অর্থ, গুরুত্ব এবং উপকারিতা :


আপনারা কি সবাই রোজ গায়ত্রী মন্ত্র জপ করুন? তবে  জেনে নিন এর প্রকৃত অর্থ, গুরুত্ব এবং উপকারিতা  :


হিন্দুধর্মে পূজা আচারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল মন্ত্র জপ করা। আমরা প্রত্যেকই দেখেছি মন্দিরে বা যেকোনও পুজোতে পুরোহিতরা মন্ত্রচ্চারণ করে এবং আমরা যখন অঞ্জলি দিই তখনও পুরোহিত আমাদের মন্ত্রচ্চারণ করায়। কিন্তু আপনি কি কখনও ভেবেছেন যে, কেন এই মন্ত্রগুলি পাঠ করা হয়? কেন বিভিন্ন দেবদেবীর জন্য বিভিন্ন মন্ত্র রয়েছে এবং এতে কী পার্থক্য রয়েছে? হয়তো আপনি ভাবেননি।


দেবী গায়ত্রী

দেবী গায়ত্রী

যেকোনও পুজোর মন্ত্র সাধারণত সংস্কৃত ভাষায় পাঠ করা হয়। মন্ত্রের প্রতিটি অক্ষরে একটি বিশেষ শব্দ রয়েছে। সংস্কৃত মন্ত্র পাঠের ক্ষেত্রে তার শব্দ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন ধরনের আওয়াজ মানুষের মানসিকতায় বিভিন্ন প্রভাব ফেলে। যেমন - বাদ্যযন্ত্রের আওয়াজ আমাদের মনকে মন্ত্রমুগ্ধ করে, বজ্রপাতের আওয়াজ আমাদের মধ্যে বিস্ময় ও ভয়ের সৃষ্টি করে।

মন্ত্র জপ আমাদের সচেতনতার স্বাভাবিক স্তর থেকে উচ্চ স্তরে উন্নীত করতে পারে। এটি অনুঘটক হিসেবে কাজ করে যা আমাদের জীবনের লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করে। মন্ত্রগুলির মধ্যে রোগ নিরাময়ের ক্ষমতা, মন্দ থেকে রক্ষা করার, ধনসম্পদ অর্জন করার, অতিপ্রাকৃতিক শক্তি অর্জন এবং এমনকি আমাদেরকে সুখী করার ক্ষমতাও রয়েছে।

এরকম একটি শক্তিশালী মন্ত্র হল 'গায়ত্রী মন্ত্র'। গায়ত্রী মন্ত্রের কিছু চমৎকার নিরাময় ক্ষমতা রয়েছে। এই মন্ত্রটি আমাদের চেতনার তিনটি স্তরকে প্রভাবিত করে - জেগে থাকা, গভীর নিদ্রা এবং স্বপ্ন। সুতরাং, গায়ত্রী মন্ত্রের আশ্চর্য নিরাময় শক্তিগুলি কী কী? আসুন বিস্তারিতভাবে তা জেনে নেওয়া যাক।

গায়ত্রী মন্ত্র

দেবনাগরী ভাষায় গায়ত্রী মন্ত্র

গায়ত্রী মন্ত্র ও মন্ত্রের প্রকৃত অর্থ :


'ওঁ ভূর্ভুবঃ স্বঃ

তৎসবিতুর্বরেণ্যং

ভর্গো দেবস্য ধীমহি

ধীয়ো য়ো নঃ প্রচোদয়াৎ'।।

এখানে এই মন্ত্রের অর্থ দেওয়া হল

ক) ওঁ : পরব্রহ্ম বা সর্বশক্তিমান ঈশ্বর

খ) ভূ : পৃথিবীলোক

গ) ভুবঃ : আকাশলোক

ঘ) স্ব : স্বর্গ

 ঙ) তৎ : চূড়ান্ত সত্য

চ) সবিতু : যাবৎ কিছুর উৎস

ছ) বরেণ্যম : এঁদের প্রণাম করা হচ্ছে

জ) ভর্গো : আধাত্ম্যশক্তি

ঝ) দেবস্য : দৈব সত্তা

ঞ) ধীমহি : ধ্যান করা হচ্ছে

ট) ধীয়ো : ধীশক্তি বা বৌদ্ধিক উৎকর্ষ

ঠ) য়ো : কে

ড) নঃ : আমাদের

ঢ) প্রচোদয়াৎ : আলোকপ্রাপ্তি

"গায়ত্রী" শব্দটি নিজেই এই মন্ত্রটির অস্তিত্বের কারণ ব্যাখ্যা করে। এটি সংস্কৃত বাক্যাংশ গায়ন্তম ত্রিয়তে ইতি-থেকে এর উদ্ভব হয়েছে।

মন্ত্রের উৎস

প্রায় ২,৫০০-৩,৫০০ বছর আগে গায়ত্রী মন্ত্র প্রথমবার উল্লিখিত হয়েছিল ঋগ্বেদে। ঋগ্বৈদিক সভ্যতা ছিল অপৌত্তলিক প্রকৃতি-উপাসক। গায়ত্রী এই উপাসনা পদ্ধতিরই অন্যতম প্রধান মন্ত্র। এই মন্ত্রটি বৈদিক সংস্কৃত ভাষায় রচিত। এটি ঋগ্বেদের একটি সূক্ত। এটি পরম মন্ত্র হিসেবে উল্লেখ করা হয়। গায়ত্রী মন্ত্র গায়ত্রী ছন্দে রচিত। হিন্দুধর্মে গায়ত্রী মন্ত্র ও এই মন্ত্রে উল্লিখিত দেবতাকে অভিন্ন জ্ঞান করা হয়। তাই এই মন্ত্রের দেবীর নামও গায়ত্রী। গায়ত্রী মন্ত্র দিয়ে শুধু পূজাই হয় না, গায়ত্রী মন্ত্রকেও পূজা করা হয়। এর অকল্পনীয় ক্ষমতার কারণে এটি যোগী এবং গুরুরা বহু বছর ধরে গোপন রেখেছিলেন।
গায়ত্রী মন্ত্র দিয়ে দেবতা সবিতৃকে আবাহন করা হয়। তাই গায়ত্রী মন্ত্রের অন্য নাম "সাবিত্রী মন্ত্র"। সাবিত্রীর ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা অনুসারে এই মন্ত্র সূর্যপূজা, যোগ, তন্ত্র বা শাক্তধর্মের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে।

বৈদিক সাহিত্যে বহুবার গায়ত্রী মন্ত্র উল্লিখিত হয়েছে। মনুস্মৃতি, হরিবংশ,ও ভগবদ্গীতায় গায়ত্রী মন্ত্রের প্রশংসা করা হয়েছে। হিন্দুধর্মে উপনয়ন সংস্কারের সময় গায়ত্রী দীক্ষা একটি প্রধান অনুষ্ঠান এবং হিন্দু দ্বিজ সম্প্রদায়ভুক্তেরা এই মন্ত্র নিত্য জপ করেন।

কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত এই মন্ত্রে পদ্যে যে বঙ্গানুবাদ করেন সেটি হল,

তিমির-রূপিনী নিশা – সবিতা-সুন্দর!
   সে তিমিরে তোমার সৃজন,
বিমল উজল আলো’ সৌন্দর্য-আধার!
   ফুল্ল-ঊষা – অপূর্ব-মিলন।
কুসুমিতা বসুন্ধরা-
   দ্যু-লোক আলোক-ভরা-
   জনয়িতা-সবিতা-সবার!
বরণীয়-রমণীয় নিত্য জ্ঞানাধার!


দেবী গায়ত্রীর তিন রূপ।
সকালে তিনি ব্রাহ্মী; রক্তবর্ণা ও অক্ষমালা-কমণ্ডলুধারিনী।
মধ্যাহ্নে বৈষ্ণবী; শঙ্খ, চক্র, গদা ধারণকারিনী।
সন্ধ্যায় শিবানী; বৃষারূঢ়া, শূল, পাশ ও নরকপাল ধারিনী এবং গলিত যৌবনা।

শব্দ-কল্পদ্রুম অনুসারে, যজ্ঞকালে একবার ব্রহ্মার স্ত্রী সাবিত্রী একা যজ্ঞস্থলে আসতে অস্বীকৃত হলে, ব্রহ্মা ক্রুদ্ধ হয়ে অন্য নারীকে বিবাহ করে যজ্ঞ সমাপ্ত করার পরিকল্পনা করেন। তার ইচ্ছানুসারে পাত্রী খুঁজতে বের হয়ে এক আভীরকন্যাকে (গোয়ালিনী) পাত্রী মনোনীত করেন ইন্দ্র। বিষ্ণুর অনুরোধে তাকে গন্ধর্ব মতে বিবাহ করেন ব্রহ্মা। এই কন্যাই গায়ত্রী।

গায়ত্রীর ধ্যানে আছে, তিনি সূর্যমণ্ডলের মধ্যস্থানে অবস্থানকারিনী, বিষ্ণু বা শিবরূপা, হংসস্থিতা বা গরুড়াসনা বা বৃষবাহনা। তিনি একাধারে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিব। হিন্দু বিধান অনুসারে, সকাল, দুপুর ও সন্ধ্যায় গায়ত্রী ধ্যান করতে হয় এবং এই মন্ত্র ধ্যান বা পাঠে মুক্তি প্রাপ্ত হয় বলে এর নাম ‘গায়ত্রী’। বেদজ্ঞ আচার্যের কাছে এই মন্ত্রে দীক্ষিত হলে তার পূণর্জন্ম হয় ও তিনি দ্বিজ নামে আখ্যাত হন। সেই কারণে দ্বিজ অর্থাৎ ব্রাহ্মণগণের উপাস্য।

গায়ত্রী জপ

গায়ত্রী মন্ত্র জপ

গায়ত্রী মন্ত্র পাঠ করার উপকারিতা :


এই বিশেষ মন্ত্রটি পাঠ করলে জীবনে অনেক উপকার হয় -

ক) বাধা দূর করে

খ) যেকোনও বিপদ থেকে রক্ষা করে

গ) অজ্ঞতা দূর করে

ঘ) আমাদের চিন্তা শুদ্ধ করে

ঙ) যোগাযোগ দক্ষতা উন্নত করে

চ) মানসিক দৃষ্টি খোলে


 গায়ত্রী মন্ত্রের নিরাময় শক্তি :

গায়ত্রী শক্তি হল একটি শক্তির ক্ষেত্র এবং এটি তিনটি শক্তির সর্বোচ্চ - তেজ বা দীপ্তি, যশ বা বিজয় এবং প্রতিভা। যখন কেউ গায়ত্রী মন্ত্র জপ করে, তখন এই শক্তিগুলি তার মধ্যে প্রকাশ পায় এবং তাকে আশীর্বাদ করার শক্তি দেয়। আশীর্বাদ গ্রহণকারীর মধ্যেও শক্তি প্রেরিত হয়। গায়ত্রী মন্ত্র বুদ্ধি তীক্ষ্ণ করে এবং আমাদের স্মৃতিকে মসৃণ করে যা সময়ের সাথে কলঙ্কিত হয়ে যায়।

গায়ত্রী মন্ত্র জপ করার আদর্শ সময় :


গায়ত্রী মন্ত্র জপ করার আদর্শ সময় হল প্রতিদিন ভোর ও সন্ধ্যায়, এমন সময় যখন অন্ধকার বা আলো নয়। এটি আত্মার দিকে মনোনিবেশ করার সঠিক সময়। এই সময়ে গায়ত্রী মন্ত্র জপ করলে মন পুনরুত্থিত হয়।

গায়ত্রী মন্ত্র জপ করলে আমাদের কি উপকার হয়?


ঋগ্বেদে উল্লেখ রয়েছে, গায়ত্রী মন্ত্র পাঠ করলে আমাদের সব ক্ষত, তা মনের হোক কিংবা শরীরের হোক বা মস্তিষ্কের, সব ধরনের যন্ত্রণার উপশম ঘটে। সেই সঙ্গে মন, খারাপ চিন্তা থেকে মুক্তি পায়। ফলে, আমাদের শরীর ইতিবাচক শক্তিতে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে এবং সর্বপরি এই মন্ত্র আমাদের আশেপাশের পরিবেশে উপস্থিত খারাপ শক্তিকেও শেষ করে দেয়। তাই, খারাপ কিছু ঘটার আশঙ্কা একেবারে কমে যায়। প্রসঙ্গত, মস্তিষ্ক এবং হার্টের কর্মক্ষমতা বাড়াতেও এই মন্ত্রটির কোনও বিকল্প হয় না বললেই চলে।

ধন্যবাদ -

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ