ঈশ্বরই সত্য এবং সত্যই ঈশ্বর


ঈশ্বরই সত্য এবং সত্যই ঈশ্বর


সকল ধর্মই সর্বসম্মতিক্রমে ঘোষণা করে যে, ঈশ্বরই সত্য এবং সত্যই ঈশ্বর। অতএব আমরা বলতে পারি যে, যখন কেউ কোন নামরূপের সাহায্যে ঈশ্বরের উপাসনা করে, তখন সে বিশ্বাস করে যে, তার উপাস্য বস্তুই সত্য। মানুষ যখন তার আধ্যাত্মিক-আদর্শের প্রতীকরূপে কোন ক্রুশ, প্রতিমূর্তি বা প্রতিমার সামনে পুষ্প, ধূপধুনাদি গন্ধদ্রব্য উৎসর্গ করে এবং তাঁকে বন্ধু, জগৎ-পিতা, জগন্মাতা, বিশ্বের প্রভু বা অন্য-কোন নামে অভিহিত ক’রে প্রার্থনা করে, তখন সে জানে যে, তার উপাস্য বস্তুই নিত্য-সত্য, অথবা অন্যভাবে বলা যায় তার বিশ্বাস এই যে, ঈশ্বরের প্রতিমূর্তির সামনে যা-কিছু অর্পণ করা যায় সে-সমস্তই তিনি দর্শন করেন।

ভববাব শ্রীকৃষ্ণ

ঈশ্বর

উৎসর্গীকৃত সকল বস্তুই ঈশ্বর গ্রহণ করেন এবং যতকিছু প্রার্থনা তাঁর নিকট করা হয় সবই তিনি শ্রবণ করেন। সংক্ষেপে বলা যেতে পারে, মানুষ বিশ্বাস করে যে, প্রতিমাপূজার সাহায্যে শাশ্বত-সত্য এবং বিশ্বের সত্তাস্বরূপ সেই ঈশ্বরেরই পূজা করা হয়। অপর ব্যক্তি যে প্রতিমাপূজকদের নিন্দা করে, সে-ও ঊর্ধ্বাকাশের দিকে চেয়ে তার আদর্শ সর্বজনীন সত্যের উপাসনা করে এবং হৃদয়ের সানুনয় আবেদন উৎসর্গ করে তাকে ক্ষমা করতে ও সকল প্রকার পাপ হতে মুক্ত করতে। কারণ সে জানে একমাত্র ঈশ্বরের করুণাই তাকে অনন্ত নরক থেকে উদ্ধার করতে পারে। সে বিশ্বাস করে, তার ঈশ্বর আকাশের ওপারে স্বর্গে অবস্থান করেন এবং ভক্তের প্রার্থনা শ্রবণ করেন ও তাকে সকল দুঃখকষ্ট থেকে উদ্ধারের জন্য তিনি আশীর্বাদ প্রেরণ করেন।
যে-কোন ব্যক্তি ভগবান বুদ্ধ, শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীরামকৃষ্ণের মতো নবরূপী অবতারের সাহায্যে ঈশ্বরের অথবা নির্বিশেষ সত্যের উপাসনা করতে পারে। সে বিশ্বাস করে যে, তার ইষ্টই নরদেহে অবতাররূপে ঈশ্বরীয় সমস্ত বিশুদ্ধ গুণাবলীর আধারস্বরূপ ও প্রকৃতির এক রহস্যময় প্রকাশ। এইসব অবতারদের প্রত্যেকেই অদ্ভুত আত্মসংযম, মানবজাতির প্রতি অহৈতুকী প্রেম, অসাধারণ আত্মত্যাগ, পার্থিব বস্তুর ও ভোগবাসনার প্রতি অতুলনীয় অনাসক্তি, অনন্যসাধারণ আধ্যাত্মিকতা ও দৈবীশক্তি এবং অননুকরণীয় আদর্শনিষ্ঠা প্রদর্শন করেছেন,—যা সাধারণ মানবে কদাচিৎ দৃষ্ট হয়। ঐ একই শাশ্বত সত্যকে যীশুখ্রীষ্ট, শ্রীকৃষ্ণ, ভগবান বুদ্ধ, শ্রীরামকৃষ্ণ অথবা তাঁদের মতো যে-কোন মহাপুরুষের মাধ্যমে উপাসনা করা যেতে পারে। যেমন একজন নৈষ্ঠিক খ্রীষ্টধর্মাবলম্বীর কাছে যীশুখ্রীষ্টের জীবন শ্রেষ্ঠ আদর্শরূপে গৃহীত হয়, একজন বৌদ্ধধর্মাবলম্বীর কাছে ভগবান বুদ্ধও সেইরূপ। অপর অনেকের কাছে আবার শ্রীকৃষ্ণ অথবা শ্রীরামকৃষ্ণই নির্বিশেষ সত্যের শ্রেষ্ঠ প্রকাশরূপে অনুভূত হয়ে থাকেন।
এইসব ঈশ্বরাবতারদের প্রত্যেকেই মহিমময়। তাঁরা প্রত্যেকেই নশ্বর মানবদের সত্যস্বরূপে উপনীত হওয়ার উন্মুক্ত দ্বারস্বরূপ। এঁরা প্রত্যেকেই নদীবক্ষে প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে নৌকার মতো জীবকুলকে আধ্যাত্মিকতার অনন্ত সমুদ্রে নিয়ে যান। এরূপ ঈশ্বরাবতারদের অনুরাগী ভক্তরা তাঁকেই সত্যস্বরূপ ব’লে বিশ্বাস করে এবং বিশ্বব্যাপী সর্বশক্তিমান ঈশ্বররূপে তাঁরই উপাসনা ও প্রার্থনা করে। নিষ্ঠাবান খ্রীষ্টধর্মাবলম্বীরা বিশ্বাস করে যে, ঈশ্বরের একমাত্র প্রিয় পুত্র যীশুখ্রীষ্ট সত্যের প্রচারকল্পে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। সত্যের যথার্থস্বরূপ সম্বন্ধে তিনি যা-কিছু বলেছিলেন, তাঁর সমগ্র জীবন বা সত্তাই ছিল সেই সত্যের প্রতিরূপ। তাঁর উপাসনার সাহায্যে তারা শাশ্বত সত্যেরই উপাসনা করে, তাঁর প্রতি বিশ্বাসই ঈশ্বর-বিশ্বাস, তাঁর প্রতি অনুরাগই হ’ল এই বিশ্বের চরমসত্তা ঈশ্বরের প্রতি অনুরাগ। তারা বলে—যদি আমরা খ্রীষ্টকে উপলব্ধি করি এবং তাঁকে জানতে পারি তাহলে পরম সত্যকেই জানা হবে এবং তাঁর যে বাণী: ‘সত্যের উপলব্ধি করো এবং সত্যই তোমাদের মুক্ত করবে,—একথা সার্থক হবে। অনন্ত নরক থেকে উদ্ধার ও মুক্তিলাভের অপর কোন পথ নেই। শ্রীবুদ্ধের ভক্তরা ঘোষণা করে: ‘সত্যই সকল বস্তুর চরম মানদণ্ড—যার দ্বারা সত্য ও মিথ্যার (এই দু’টি মতবাদের) মধ্যে পার্থক্য বিচার করা যায়। অতএব সত্যকে যেন আমরা পূজা করি এবং সত্য সম্বন্ধে অনুসন্ধান ক’রে তার স্বরূপ অনুভব করি এবং সত্যেরই অনুগামী হই। যেহেতু আমাদের আচার্য, প্রভু বুদ্ধই যথার্থ-সত্যস্বরূপ’।

 গোবিন্দ-কথা

নারদ বলছেন—বিচিত্র রস, ভাব, অলংকার-যুক্ত বাক্যও যদি গোবিন্দ-গুণ-বর্ণন-হীন হয়, তবে তা সাধু ব্যক্তিরা পছন্দ করেন না। কিন্তু অপশব্দের দ্বারা রচিত গোবিন্দ-কথাও ভক্তেরা আনন্দের সঙ্গে শ্রবণ, বর্ণন ও কীর্তন করে থাকেন; আর তাতেই জীবের সমস্ত পাপ দূর হয়। তাই বলছি:
হে মহাভাগ্যবান ব্যাসদেব, তুমি অমোঘদৃক্‌ অর্থাৎ অব্যর্থ দৃষ্টি, তোমার জ্ঞান যথার্থ; তুমি শুচিশ্রবা অর্থাৎ প্রথিতযশা। জগতের জীবের ভব-বন্ধন মোচনে যদি যথার্থই তোমার অভিলাষে হয়ে থাকে, তবে সত্যরতো—ভগবানে রত এবং ধৃতব্রত—দৃঢ়চিত্ত হয়ে, একাগ্রচিত্তে অচিন্ত্যশক্তিশালী শ্রীগোবিন্দের মধুর লীলাবলী বার বার স্মরণ কর। এইভাবে বার বার গোবিন্দলীলার ধ্যান করতে করতে তোমার মধ্যে গোবিন্দলীলার স্ফুরণ হবে; তখন তা বর্ণনা করলে জগতের কল্যাণ হবে। বহির্মুখ লোকেরা নানা কথা বলে, নানা কাজ করে; কিন্তু কিছুতেই চিত্তের স্থিরতা আনতে পারে না। সংসার-সমুদ্র পার হতে হলে, চিত্তের স্থিরতা লাভ করতে হলে শ্রীগোবিন্দ-কথার আশ্রয় ছাড়া তো আর কোন উপায় নেই। ব্যাসদেব, তুমি বিচক্ষণ ব্যক্তি। তুমি তো জান যতদিন বিষয়-বাসনা থাকবে, ততদিন ভগবানের দিকে মন যাবে না। তাই বলছি, তুমি মধুর গোবিন্দ-লীলা বর্ণনা কর। গোবিন্দ-লীলা শ্রুতি-সুখকর এবং হৃদয়ে আনন্দ এনে দেয়—একাধারে ভোগ ও মোক্ষ—প্রবৃত্তির আবরণে নিবৃত্তি। গোবিন্দ-লীলার আশ্রয় নেওয়া মাত্র জীবের বিষয় বাসনা দূর হয় এবং গোবিন্দ-সেবার লালসা জন্মে। পুত্রকামী ব্যক্তিকে পুত্রের আশা ছাড়তে বলার চেয়ে ভগবানকে পুত্ররূপে পাবার পথ দেখানেই তো ভাল ফল হবে। শ্রবণ-সুখলিপ্সু ব্যক্তিকে গোবিন্দ-গুণ কথা শোনালেই তার যথার্থ সুখ হবে এবং তার যথার্থ মঙ্গল করা হবে। তাই বলি, তুমি গোবিন্দ-লীলার ধ্যান কর এবং ধ্যান করতে করতে তোমার হৃদয়ে যে গোবিন্দ-লীলার স্ফূর্তি হবে, তাই বর্ণনা কর। সেই গোবিন্দ-লীলা পাঠ করে, সেই লীলা শ্রবণ করে লোকের যথার্থ কল্যাণ হবে, তাদের সর্বার্থ সিদ্ধ হবে।
দেবর্ষি নারদ চলে যাবার পর ব্যাসদেব, নারদের কথার সারবত্তা হৃদয়ঙ্গম করে শ্রীগোবিন্দের ধ্যানে নিরত হলেন। ধ্যান-যোগে তিনি ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এবং তাঁর অংশ—মৎস্য, কুর্ম, বরাহ, নৃসিঙ্ঘ, বামন প্রভৃতি অবতারের যে সব লীলা দর্শন করলেন, তা-ই তিনি শ্রীমদ্ভাগবত-রূপে জগতে প্রচার করলেন। ব্যাসদেব সমাধিতে সমস্ত অনর্থদূরকারী অর্থাৎ সংসার-বাসনা ক্ষয়কারী ভক্তিযোগের জ্ঞান লাভ করলেন। তখন বিষয়ান্ধ জীবের কল্যাণের জন্য সাত্বত সংহিতাম্‌—শ্রীমদ্ভাগবত সংহিতা প্রণয়ন করলেন। কি রকম সেই ভাগবত সংহিতা? ভাগবত কোন রকমে একটুমাত্র শ্রবণ করলেই পরমপুরুষ শ্রীকৃষ্ণে ভক্তিলাভ হয় এবং জীবের শোক, মোহ, ভয়, অর্থাৎ ভব-ভয় দূর হয়। সুতরাং বোঝা যাচ্ছে যে, ব্যাসদেবের হৃদয়াকাশে বিভাসিত শ্রীমদ্ভাগবত শ্রীভগবানেরই অশেষ করুণার দান।
ভাগবত রচনা করে ব্যাসদেব ভাবলেন—এই অমৃত এখন কোন্‌ পাত্রে রাখা হবে—কার মাধ্যমেই বা এই অমৃত জগতে পরিবেশিত হবে? তখন অনেক ভেবে চিন্তে তিনি ঠিক করলেন যে, একমাত্র তাঁরই পুত্র শুকদেব, যিনি আজন্ম সংসার-ত্যাগী, ব্রহ্মধ্যানে সদা নিরত, একমাত্র সেই শুকদেবই এই অমৃত ধারণ করতে সক্ষম—জগতে একমাত্র সে-ই যথার্থরূপে ভাগবতের প্রচার করতে পারবে। তাই তিনি শুকদেবকে আনিয়ে উপদেশ করলেন এই শ্রীমদ্ভাগবত।

 ভগবান

তুমি ভগবানকে ডাক, কিন্তু তোমার এত ভেদ-বুদ্ধি কেন? মুসলমানের ভগবান, খ্রিষ্টানের ভগবান কি আলাদা? ভগবান তো অনেক নয়—এক; তার মধ্যে আবার ছোট-বড়, এর ভগবান, তার ভগবান—এ-সব কি বুদ্ধি? ও-রকম হীন বুদ্ধি থাকলে ভগবানকে পাওয়া যায় না। তোমার ইষ্ট তোমার কাছে বড়; তাদের ইষ্ট তাদের কাছে বড়; ইষ্ট কিন্তু এক, কেবল নামের তফাত—ভাব নিয়ে কথা। যে ভগবান তোমার ইষ্ট, সেই ভগবানই তাদের ইষ্ট; তারা এক নামে ডাকছে, তুমি আর এক নামে ডাকছ—এই তফাত। তবে ভেদ-বুদ্ধি কেন? যে ভগবানকে চায়, সে ভেদবুদ্ধি ত্যাগ করবে।
তুলসীদাস, রামপ্রসাদ—এঁরা সব ইষ্ট-লাভ করেছিলেন; রামপ্রসাদের কত বৈরাগ্য, কেমন প্রেম—মাকালীকে ঠিক ঠিক মায়ের মতো ভেবে গালি দিচ্ছে, আবদার কচ্ছে। লোকে মানুষের কাছেই আবদার-জুলুম করে, কিন্তু তিনি মানুষ নন—অশরীরী, তবুও তাঁর কাছে আবদার-জুলুম কচ্ছে। কতখানি ভক্তি-বিশ্বাস হলে এমন করে। ইষ্টকে আপন হতে আপন ভাবতে হয়; তিনি আত্মা—আত্মীয়ের চেয়ে বড়, আরো কত আপন।
কালী মহারাজ (স্বামী অভেদানন্দ) স্বামীজীর আদেশে বিলেতে গেল। যখন স্বামীজী লেকচার দিতে বললে, তখন ভয় পেয়ে বললে—‘‘আমি পারবো না; কি করে বলবো?’’ স্বামীজী বললে—‘‘আমি যাঁর মুখ দেখে বলেছিলাম, তুমিও তাঁর মুখ দেখে বল।’’ তখন আর ভয় রইল না—খুব ভাল বললে।
সত্যভামার মহিষী হবার ইচ্ছা হয়, রুক্মিণীর মনে মনে হিংসা। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তা জানতে পারলেন। একদিন তিনি সভ্যভামার সঙ্গে বসে আছেন, এমন সময় দেখলেন হনুমান আসছেন। তখন সত্যভামাকে বললেন—‘‘তুমি শীঘ্র সীতারূপ ধর, আর আমি রামরূপ ধরি—হনুমান অন্যরূপ দেখবে না।’’ সত্যভামা সীতারূপ ধরতে পারলেন না। এমন সময় স্বয়ং লক্ষ্মী রুক্মিণী এসে সীতারূপ ধরলেন। হনুমান রামরূপ ছাড়া অন্যরূপ দেখতে ভালবাসতেন না। বলতেন—

শ্রীনাথে জানকীনাথে অভেদঃ পরমাত্মনি।
তথাপি মম সর্বস্বঃ রামঃ কমললোচনঃ ।।

গুরু-বাক্য ছাড়তে নেই। লোকে যাই বলুক না কেন, কখনও সংশয় করবে না। স্বচক্ষে না দেখে কোন কথা বিশ্বাস করা ঠিক নয়, আর কারো উপর সংশয় করা ভুল। সাধু-মহাপুরুষরা সকলেই বলেছেন—‘গুরুর হুকুম নিষ্ঠার সহিত পালন করলে কল্যাণ হবে। গুরুবাক্যে নিষ্ঠা হলে তবে ইষ্টে নিষ্ঠা হয়। যার গুরুতে নিষ্ঠা নেই, তার ইষ্টে কোনকালই নিষ্ঠা হবার আশা নেই, আর তাই কল্যাণেরও আশা নেই। এ জগতে একমাত্র গুরুই ভরসা।’ ‘গুরু-বাক্য মূলাধার, গুরু পদ ভরসা।’
গুরুর ছবি পূজা করা যেতে পারে, তাতে শিষ্যের কল্যাণই হয়। সময় মত পূজা না করলে অকল্যাণ হয়। অসময়ে পূজো করার চেয়ে না করাই ভাল। আমার তো খুব ইচ্ছা পূজো করি, কিন্তু শরীর সুস্থ নয়, পারি না। তোর এটা মনে রাখা উচিত যে, ঠাকুর এখনও জল পর্যন্ত খাননি। এত বেলায় কি পূজো হয় রে? তুই ভোগ দিবি, তবে ঠাকুর খাবেন। তোর যেমন ক্ষুধা পায়, তাঁরও তেমনি পায়। প্রত্যক্ষ তিনি রয়েছেন—অন্নগ্রহণ করেন দেখেছি। তাঁকে কষ্ট দিলে ভুগতে হবে। উপলক্ষ্য না মানলে ভগবানও সন্তুষ্ট হন না; দেখ না দ্রৌপদীকে শ্রীকৃষ্ণ সখী বলে কতই ভালবাসতেন। তাঁরই বিপদের সময়—সেই বস্ত্র-হরণের সময় কতই তিনি অনাথ-নাথ, দীন-বন্ধু, বিপদ-বারণ, লজ্জা-নিবারণ ব’লে ডাকলেন, তিনি এলেন না। কিন্তু যেই দ্রৌপদী পাণ্ডব-নাথ, পাণ্ডব-সখা ব’লে ডাকলেন, তখনই তিনি এলেন।

ভগবানে প্রেম

ভগবানকে কর তুমি তোমার জীবনের কেন্দ্র। তোমার শরীরের প্রতিটি অণু-পরমাণুতে যৌবন আসিয়া ডাক ছাড়িতেছে,—‘‘আমি আসিয়াছি।’’ তুমিও তাহার সঙ্গে সঙ্গে ডাক ছাড়িয়া বলিতে সমর্থ হও,—‘‘আমার দেহ-মন্দিরে ভগবানও আসিতেছেন।’’ যৌবনকে তুমি সম্বর্দ্ধনা কর, তোমার জীবনের বসন্তকে তুমি ব্যর্থ যাইতে কেন দিবে? যৌবন কেবল দেহের রন্ধ্রে রন্ধ্রে পিক-কুল-কুজনই জাগাইতে আসে নাই, তোমাকে ভগবানের প্রেমে মজাইতে এবং মাতাইতেও আসিয়াছে। তোমাকে দেখিয়া নিখিল বিশ্বের কত যুবক ভগবানের প্রেমে মাতিবে,—তোমার যৌবন তাহারও জন্য আসিয়াছে। যৌবনকে অবহেলা করিও না। তাহাকে আদর করিয়া বরণ কর। যৌবনকে বৃথা অপচয়িত হইতে দিও না, তাহাকে জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজে, মহত্তম তপস্যায় নিয়োজিত করিয়া সার্থক কর। আসিল এবং চলিয়া গেল, তোমার যৌবন যেন এমন না হয়। আসুক সে তোমার সুদূর বার্দ্ধক্যের তুষারশুভ্র সৌন্দর্য্যেও তোমার নিত্যসাথী হইয়া থাকিবার জন্য। যে আসিয়াছে, তাহাকে থাকিতে দাও তোমার জীবনব্যাপী সাফল্যের ও গৌরবের সাক্ষী হইয়া।
শরীরের প্রতি অণু-পরমাণু হইতে যেন নবশক্তির নির্ঝর বহিতেছে, — ইহাই ত’ যৌবন। প্রতিটি ইন্দ্রিয় জগতের বিষয়াবলীকে নূতন দৃষ্টিতে দেখিতেছে। প্রত্যেকটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে নূতন জাগরণ, নূতন শিহরণ তুমি অনুভব করিতেছ। এই সময়ে লক্ষ্য রাখিও, জীবনের শ্রেষ্ঠ আদর্শ যেন তোমার সঙ্গছাড়া না হয়। অভ্যাস, রীতিনীতি, আশা, বিশ্বাস, কর্ম্মভঙ্গী, রুচি—সবই ত’এখন তোমার অনুকরণীয় হওয়া উচিত। তুমি আজ যাহা, সুদূর ভবিষ্যতেও তোমাকে তাহাই থাকিতে হইবে, এই পণ লইয়া তুমি আত্মগঠন করিতে লাগিয়া যাও। যৌবনে যে বেহিসাবী, বার্দ্ধক্যে তাহার দুঃখ রুধিবে কে? আজ যখনি যাহা ভাল-মন্দ করিতেছ, সুদ শুদ্ধ তাহা যে তোমাকে পঁচিশ বৎসর পরে গণিতে হইবে। হিতকথা আজ কান দিয়া শোন, হিতবুদ্ধি আজ মন দিয়া গ্রহণ কর, হিতপথে আজ সর্ব্বশক্তি লইয়া চল। যৌবনের নবজাগ্রত উদ্বেল তরঙ্গ যেন তোমার চরিত্রের সৌধ না ভাঙ্গিতে পারে। ইহাই ত’সময়, যখন তোমাকে চপলতার কবল হইতে সযত্নে সতর্ক দৃষ্টিতে নিজের সম্পত্তি রক্ষা করিয়া চলিতে হইবে। যৌবনে অসংযমী হইয়া জীবনকে চিরকালের জন্য দুঃখ, দারিদ্র্য, ব্যাধি, অসাফল্য ও দুর্ব্বলতার কাছে বন্ধক রাখিও না। তোমার জীবনকে তুমি সর্ব্বশক্তি দিয়া সর্ব্বপ্রকার কলুষ হইতে রক্ষা করিয়া চল, কারণ, তাহা হইলেই জীবন সুদীর্ঘকাল উপভোগ্য থাকিবে। ক্ষণিকের ভোগ-সুখের ইন্ধন জ্বালাইয়া জীবনের সুচিরস্থায়ী ভোগ-সামর্থ্য ও অনন্ত ভোগের সুযোগকে চিতাভষ্মে উড়াইয়া দিও না। এমন সদভ্যাস-সমূহ আজ আয়ত্ত কর, যাহা পরিপক্ক বার্দ্ধক্যে হইবে তোমার জীবনের পরম সহায় ও একান্ত রক্ষক।
তোমার সর্ব্ব অঙ্গে জাগরণ আসিয়াছে। এমন সময়ে মনকে কি ঘুমন্ত থাকিতে দিবে? দেহের জাগরণ তোমার চক্ষে বক্ষে, চর্ম্মে, কর্ম্মে নানা উদ্দীপনার সৃষ্টি করিতেছে। এই সময়ে মনকেও কি উদ্দীপ্ত করিয়া তুলিবে না? শরীরের প্রতি অঙ্গে নিত্য-নূতন ক্ষুধা জাগিয়া উঠিতেছে, সেই ক্ষুধা তোমার মনে কত স্বপ্নের কুহেলী সৃষ্টি করিতেছে। মনকে কি সেই কুহেলিকার আবেষ্টন হইতে মুক্ত হইয়া সরল মেরুদণ্ডে দাঁড়াইতে দিবে না?

বিশ্বাস

বিরাট অট্টালিকার প্রধান ভিত্তিপ্রস্তরের মতো ভগবদ্‌  বিরাট অট্টালিকার প্রধান ভিত্তিপ্রস্তরের মতো ভগবদ্‌ বিশ্বাসই সব ধর্মের সার ও মূলভিত্তি। এটিই প্রাচীন ও আধুনিক সমস্ত জাতির ধর্মশাস্ত্রের মূল সুর এবং সব মতবাদ ও ধর্মসম্প্রদায়ের আধার বা ভিত্তিস্বরূপ। ই সব ধর্মের সার ও মূলভিত্তি। এটিই প্রাচীন ও আধুনিক সমস্ত জাতির ধর্মশাস্ত্রের মূল সুর এবং সব মতবাদ ও ধর্মসম্প্রদায়ের আধার বা ভিত্তিস্বরূপ। হিন্দু, জরথুষ্ট্র, খ্রীষ্টান ও ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা বহুশতাব্দী যাবৎ প্রচার ক’রে আসছেন যে, ভগবদ্‌ বিশ্বাস অঘটন ঘটাতে পারে এবং মুক্তিলাভের এটিই প্রকৃষ্ট পথ বা সাধনা। বর্তমান যুগের একজন হিন্দু-মহাত্মা বলেন: “যাঁর বিশ্বাস আছে, তাঁর সবই আছে, যাঁর বিশ্বাস নাই, তাঁর কিছুই নাই”। 

বিশ্বাসেই অধ্যাত্মজীবনের সূচনা, সন্দেহেই আধ্যাত্মিক মৃত্যুর লক্ষণ। যীশুখ্রীষ্টের উপদেশাবলীর মধ্যেও আমরা এই অভিব্যক্তি দেখতে পাই। ডূমুর-গাছটি ধ্বংস ক’রে যীশু তাঁর শিষ্যগণের কাছে বলেছিলেন: ‘নিশ্চয় ক’রে তোমাদের বলছি,—
যদি তোমরা বিশ্বাস করো এবং নিঃসন্দেহ
হও তবে ডুমুর-গাছটির অবস্থা যেমন হয়, তোমরা কেবল তাই করতেসমর্থ হবে না, পরন্তু যদি পর্বতটিকে বলো তুমি অপসারিত হও, এবংসমুদ্রে নিক্ষিপ্ত হও তা-ই হবে এবং বিশ্বাস ও প্রার্থনার সাহায্যে যা-কিছু আকাঙ্ক্ষা করবে তাই পাবে’।
বিশ্বাস বলে রোগনিরাময়কারী ব্যক্তিরা (faith-healers) বিশ্বাসের প্রভূত শক্তির বিষয় অবগত আছেন। অতি-প্রাচীনকাল থেকেই বিশ্বাস
বলে ভারতবর্ষে রোগ-নিরাময়কারী ব্যক্তিরাও বিশ্বাস-শক্তির কথা জ্ঞাত ছিলেন এবং বহুরকম ব্যাধি তাঁরা এভাবে নিরাময় করেছিলেন।
অধুনা আমেরিকার মেন্টাল সায়েন্টিস্টস্‌ (Mental Scientists), ডিভাইন্‌ হিলার্‌স্‌ (Divine healers), ক্রিশ্চিয়ান্‌ সায়েন্টিস্টস্‌ (Christian Scientists) ও নিউ থটিস্টস্‌ (New Thoughtists) সম্প্রদায়রা ঐ একই উপায়ে রোগ নিরাময় ক’রে থাকেন।
সুতরাং বিশ্বাসের যে অদ্ভুত শক্তি আছে এ সম্বন্ধে কোন সন্দেহ নেই। মানব-মন বিশ্বাসরূপ এই বিস্ময়কর শক্তির অধিকারী। এঁকে বিভিন্ন জাগতিক বিষয়ের দিকে অথবা ঈশ্বরাভিমুখী করা যেতে পারে। ইতিহাসপাঠে আমরা জানতে পারি যে, যে-কোন ব্যক্তি যদি ঈশ্বরের বিশেষ নাম-রূপে বিশ্বাসস্থাপন করতে পারে তবে সে তাঁরই সাহায্যে অদ্ভুত সাফল্য লাভ করতে সক্ষম হবে; আবার অপর কোন ব্যক্তি যদি অবতার, ধর্মগুরু,মহাত্মা বা কল্পিত মহাত্মা অথবা কোন মূর্ত আদর্শ বা প্রতিমা অথবা স্বীয় আত্মায় বিশ্বাসস্থাপন করে তবে একই ফল লাভ করতে পারে। যে-কোন নামেই আমরা বিশ্বাসের বস্তুকে আরাধনা করি না কেন, এটি কোনরূপ বাধার সৃষ্টি করে না, তবে এটুকু সত্য যে, বিশ্বাসই মহতী শক্তি। এই সত্যের সঙ্গে আমরা সকলেই পরিচিত।

সত্য উপলব্ধি

প্রায় দু’হাজার বৎসর আগে ন্যাজারেথবাসী যীশু জগৎ-সমক্ষে ঘোষণা করেছিলেনঃ ‘সত্য উপলব্ধি কর, সত্যই তোমাকে মুক্তি দান করবে।’ সত্যের উপলব্ধিই মানবাত্মাকে বন্ধনমুক্ত করে; সমস্ত খ্রীষ্টান-সম্প্রদায়ের মানুষ যাঁকে ঈশ্বরের একমাত্র প্রিয়পুত্ররূপে পূজা করেন সেই মহান ব্যক্তিই ধর্মের এই সারমর্মটি প্রচার করেছিলেন। যীশুখ্রীষ্টের আবির্ভাবের পাঁচশত বৎসর আগে গৌতম-বুদ্ধ ভারতবর্ষে ঘোষণা করেছিলেনঃ ‘সত্যদ্রষ্টা ব্যক্তিমাত্রই সুখী। সত্য সুন্দর ও মহান এবং সত্যই দুষ্কৃতি থেকে রক্ষা করতে পারে। সত্য ব্যতীত পৃথিবীতে আর কোনকিছুই মুক্তি দান করতে পারে না।’ আবার বুদ্ধের আবির্ভাবেরও বহু শতাব্দী আগে বৈদিক ঋষি ও মহাত্মাগণ প্রচার করেছিলেন যে, সত্যলাভই জগতে সকলের লক্ষ্য। সত্য হতে আমরা জন্মেছি, সত্যেই আমাদের অধিষ্ঠান এবং পরিশেষে সত্যেই আমরা প্রত্যাবর্তন করব। যে-কোন সত্যদ্রষ্টা পুরুষ মুক্তি এবং পরমাশান্তি ও আনন্দ লাভ ক’রে থাকেন। একদিকে পৃথিবীর অতীত যুগের সকল ধর্ম ও তার শ্রেষ্ঠ আচার্যগণ এই শিক্ষাই দান করেছিলেন যে, সত্যের উপলব্ধিই শ্রেষ্ঠ আদর্শ এবং ইহাই মানুষকে মুক্তি দান করে। অপরপক্ষে সকল দেশের ও সকল যুগের ধর্মশাস্ত্রী, দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিকেরা সর্বপ্রযত্নে সত্যানুসন্ধানের পর এই বাণীই প্রচার করেছিলেন যে, সত্যানুভূতিই সকল জ্ঞানের চরম-সার্থকতা। সত্যকে জানা বা সত্যের উপলব্ধিই সম্রাট, ভিক্ষুক, ধর্মনেতা এবং প্রাচীন ও বর্তমান ভারতের মহাত্মাগণের একমাত্র উদ্দেশ্য। সমস্ত দর্শন, বিজ্ঞান ও ধর্মের লক্ষ্যই হ’ল মানব-মনের বিবিধ প্রচেষ্টার মাধ্যমে সত্যকে উপলব্ধি করা এবং শাশ্বত সত্যকে জানা। বর্তমান যুগের বৈজ্ঞানিকেরাও ঐ একই আদর্শের ধারক।
এযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক আর্নেস্ট হেকেল বলেনঃ ‘প্রকৃত বিজ্ঞানের প্রচেষ্টাই হল সত্যের জ্ঞানলাভ করা।’ যদি সত্যোপলব্ধিই আমাদের জীবনে শ্রেষ্ঠ আদর্শ হয়, তবে আমাদের মনে কেবল এই প্রশ্নই জাগেঃ ‘যাঁকে জানলে মানবাত্মা মুক্ত হয় এবং শান্তি লাভ করে সেই সত্যের স্বরূপ কি এবং কি উপায়েই বা সেই জ্ঞান লাভ করা যায়?’ প্রথমত যদি আমরা ‘সত্য’ এই শব্দটির বিভিন্ন ব্যাখ্যাসম্বন্ধে বিশ্লেষণ করি তাহলে জানতে পারব যে, সূক্ষ্মার্থের দিক দিয়ে ‘সত্য’ এই শব্দটি যা কিছু বিশ্বজনীন তারই নির্দেশক। কিন্তু ধর্ম যখন সাম্প্রদায়িকভাবে ও বিশেষ কতকগুলি আচার ও মতবাদের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে তখন সে তার মৌলিক সর্বজনীন অর্থটি হারিয়ে ফেলে।
উদাহরণস্বরূপ, ‘সত্যকে জানো এবং সত্যোপলব্ধি করলেই মুক্ত হবে’— এই অংশটির ব্যাখ্যাপ্রসঙ্গে প্রাচীনকালের শাস্ত্রবেত্তাগণ বলেছিলেনঃ ‘যীশুখ্রীষ্টই ঈশ্বরের একমাত্র পুত্র যিনি জগতে মানবের ত্রাণকর্তারূপে অবতীর্ণ হয়েছিলেন—এটিই প্রকৃত সত্য এবং এতে অবশ্যই বিশ্বাস করবে। এই সত্যে বিশ্বাসের বলেই মানুষ সকল প্রকার পাপ হতে মুক্ত হবে এবং ঈশ্বরও তাকে ক্ষমা করবেন।’
বহু ধর্মশাস্ত্রী-কর্তৃক উপরি-উক্ত ব্যাখ্যাটিই দেওয়া হয়েছিল। আবার অন্য অনেকে একটু ভিন্নরূপ ব্যাখ্যাও দিয়েছিলেন। যেমন, যীশুখ্রীষ্ট পৃথিবীতে উচ্চতম সত্যের প্রচারকল্পে অবতীর্ণ হয়েছিলেন এবং তাঁর জীবনই ছিল সত্যের মানদণ্ডস্বরূপ। যদি তাঁর জীবন ও বাণীতে আমাদের বিশ্বাস থাকে তবে তা-ই সত্যোপলব্ধি করতে সাহায্য করবে এবং সত্যের স্বরূপ কি তা আমরা জানতে সক্ষম হ’ব ও পরিণামে মুক্তিলাভ করব। এজাতীয় চিন্তাশীল ব্যক্তিদের কাছে অন্য কোন ব্যাখ্যাই গ্রহণযোগ্য নয়। পক্ষান্তরে এইসব ব্যক্তিরা তাঁদের সংকীর্ণ মতবাদ ও ধারণার বহির্ভূত কোনকিছুই গ্রহণ করবেন না।

 ভক্তি-মুক্তি-প্রদ

ব্যাসদেব ভাগবত রচনা করে ভাবলেন যে, সদ্য ভক্তি-মুক্তি-প্রদ এই ভাগবত-ভাব জগতে প্রচার করা দরকার রবং তার একমাত্র সুযোগ্য অধিকারি হচ্ছে শুকদেব। কিন্তু তাকে পাওয়া যাবে কোথায়? সে তো ব্রহ্ম-ধ্যানে সমাধিস্থ হয়ে কোন গভীর অরণ্যে অথবা পর্বত-কন্দরে রয়েছে; আবার ভাবলেন যে, ভগবানের নামের তো এমনই মহিমা, এমন-ই আকর্ষণী শক্তি, যা ব্রহ্মজ্ঞানীর মনকে পর্যন্ত সমাধি থেকে নামিয়ে ভগবল্লীলার স্মরণে নিয়োজিত করে।
প্রশ্ন করা হয়েছিল যে, যাঁরা আত্মারাম, ব্রহ্ম-মনন-শীল, তাঁরা তো সকল প্রকার বিধি নিষেধের অতীত; তাঁদের চাইবার কিংবা পাবার তো কিছু নেই; সুতরাং তাঁদের শাস্ত্রপাঠ করার কিংবা শোনাবার প্রবৃত্তি হয় না। তবুও শুকদেব কেন ভাগবত অধ্যয়ন করলেন এবং অপরকে তা শোনালেন? উত্তরে বলা হয়েছে, ইত্থম্ভূত গুণো হরিঃ—ভগবানের এমনই আকর্ষণ যে, নিবৃত্তি-নিষ্ঠ আত্মারামেরা পর্যন্ত ভগবানে অহৈতুকী ভক্তি করে থাকেন, ভগবল্লীলা শ্রবণে লালসা-যুক্ত হয়ে পড়েন।
ব্যাসদেব এক ফন্দি আঁটলেন। তিনি কাঠুরিয়াদের ডেকে বললেন—তোরা তো কাঠ আনবার জন্য বহু দূরে দূরে পাহাড়ে জঙ্গলে যাস। তোরা একটা কাজ করবি? কাঠুরিয়া বললে—নিশ্চয়ই করব। ব্যাসদেব বললেন, আমি একটা গান তোদের শিখিয়ে দেব; তোরা যখন পাহাড়ে জঙ্গলে কাঠ আনিতে যাবি, তখন উচ্চৈঃস্বরে এই গানটি গাইবি। এই গান শুনে যদি কেউ এসে তোদের জিজ্ঞাসা করে—এ গান তোমরা কোথায় শিখলে? তখন তোরা আমার নাম করবি না; শুধু বলবি—তুমি তাকে দেখবে? তখন সে যদি রাজি হয়, তবে তাকে আমার কাছে নিয়ে আসবি। ব্যাসদেব তখন ভাগবত থেকে শ্রীকৃষ্ণের কিশোর বয়সের একটি রূপ-বর্ণনা-সূচক শ্লোক গান করে কাঠুরিয়াদের শেখালেন:
অতি সুন্দর ময়ূরপুচ্ছ যাঁর শিরোভূষণ, নটশ্রেষ্ঠের মতো সুন্দর যাঁর শরীর, যাঁর কানে কর্ণিকা ফুলের কুণ্ডল শোভা পাচ্ছে, যিনি পীতবসন পরিধান করেছেন, গলায় বৈজয়ন্তীমালা ধারণ করে তিনি অধর সুধায় বংশীধ্বনি করছেন। গোপবালকেরা তাঁর মহিমা কীর্তন করছেন এবং তিনি নিজ পদাঙ্ক চিহ্নে পরিশোভিত বৃন্দাবনে প্রবেশ করলেন।
দূর থাকে এই পরম মনোহর গীতধ্বনি শুকদেবের কানে যেতেই ধীরে ধীরে তিনি সমাধি থেকে ব্যুত্থিত হলেন। এই প্রসঙ্গে শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত থেকে একটু উদ্ধৃতি দিচ্ছি। “শুকদেব সমাধিস্থ ছিলেন। নির্বিকল্প সমাধি—জড় সমাধি। ঠাকুর নারদকে পাঠালেন—পরীক্ষিতকে ভাগবত শোনাতে। নারদ দেখলেন, জড়ের ন্যায় শুকদেব বাহ্যশূন্য—বসে আছেন। তখন বীণার সঙ্গে হরির রূপ চারশ্লোকে বর্ণনা করতে লাগলেন। প্রথম শ্লোক বলতে বলতে শুকদেবের রোমাঞ্চ হল। ক্রমে অশ্রু; অন্তরে, হৃদয় মধ্যে, চিন্ময়রূপ দর্শন করতে লাগলেন। জড় সমাধির পর আবার রূপ দর্শনও হলো।”
কাঠুরিয়াদের গানেই ফিরি। কৃষ্ণ বিষয়ক গান শুনতেই শুকদেব সমাধি থেকে ব্যুত্থিত মুগ্ধ হলেন; ভাবলেন—কারা এই গান গাইছে? কাঠুরিয়াদের কাছে গিয়ে প্রশ্ন করলেন—এ গান তোমরা কোথায় শিখলে? কাঠুরিয়া বললে—তুমি তার কাছে যাবে? শুকদেব রাজি হতেই কাঠুরিয়ারা তাঁকে ব্যাসদেবের কাছে নিয়ে এলেন। শুকদেব জিজ্ঞাসা করলেন—বাবা, এই গানের বিষয় কে? ব্যাসদেব বললেন—তিনি হলেন পরব্রহ্মেই এক পরম মাধুর্যমণ্ডিত মূর্তি; ইনি হলেন লীলাময় ব্রহ্ম, ভগবান শব্দ বাচ্য। যিনি জ্ঞানীদের ব্রহ্ম, তিনিই যোগীদের পরমাত্মা এবং তিনি ভক্তদের ভগবান।

মধুরকথা

সংসারে বাস ক’রে যারা মোক্ষলাভের জন্য সাধনা করে তারা সুরক্ষিত কেল্লার ভেতর থেকে যুদ্ধ করা সৈনিকদের মতো। আর যারা ঈশ্বরলাভের জন্য সংসারত্যাগ করেছে তারা যেন খোলা মাঠে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করা সৈনিক। খোলা মাঠে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করার চেয়ে কেল্লার ভেতর থেকে যুদ্ধ করা অনেক সহজ ও নিরাপদ।
খই ভাজবার সময় কতকগুলো ফেটে গিয়ে লাফিয়ে কড়ার বাইরে পড়ে। খইয়ের মধ্যে এগুলোই সবার সেরা, গায়ে এতটুকু দাগ নেই। কড়ার ভিতরের খই ভালোরকম ভাজা হ’লেও গায়ে একটু-আধটু পোড়া দাগ থেকে যায়। উত্তম ভক্তদের মধ্যে যারা সংসারত্যাগ ক’রে বেরিয়ে যায়, তাদের এতটুকু দাগ থাকে না। সংসারী উত্তম ভক্তদেরও চরিত্রে কিছু-না-কিছু দাগ থেকে যায়।
প্রশ্ন: যারা মনের জোরে নয়, সাময়িক বিরক্তিতে সংসারত্যাগ করে তাদের চরিত্র কিরকম হয়?
উত্তর: বাবা, মা কিংবা বৌয়ের সঙ্গে ঝগড়া ক’রে যারা সংসারত্যাগ ক’রে দূরে কোথাও চলে যায় তাদের বলে শ্মশান-বৈরাগী। এরূপ বৈরাগ্য বেশীদিন থাকে না। মনোমত একটা কাজ জোগাড় করতে পারলেই এদের বৈরাগ্যভাব মিলিয়ে যায়। এরা কিছু টাকা-পয়সা জমিয়ে সংসারে ফিরে আসেই।
পরিষ্কার সাদা কাপড়ে বিন্দুমাত্র কালির দাগ লাগলেও চোখে পড়ে। সেইরকম পুণ্যাত্মা সাধুর মধ্যে এতটুকু দোষ খুঁজে পেলে তাঁর পবিত্রতার পাশে ঐটুকু দোষই বড় চোখে লাগে। কষ্টিপাথরে ঘষলে তবে বোঝা যায় কোনটি সোনা আর কোনটি পিতল। সেইরকম যন্ত্রণা ও দুর্দশার কষ্টিপাথরে খাঁটি সাধু ও কপট লোকের যাচাই হয়ে যায়। যে সাধু ওষুধ বিলোয় আর নেশা করে সে ঠিক ঠিক সাধু নয়। তার সঙ্গ এড়িয়ে চলো। আকাশে লক্ষ লক্ষ ঘুড়ির মধ্যে মাত্র একটি দু’টি ঘুড়ি কাটে। সেইরকম শত শত সাধকের মধ্যে থেকে দু’একজনই মাত্র সংসারের বন্ধন কেটে বেরিয়ে আসতে পারে।
জালে মাছ পড়লে কতকগুলো মাছ শান্ত হয়ে জালেতেই ঘোরাঘুরি করে, কতকগুলো জাল থেকে বেরোবার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করে এবং মাত্র অল্প কয়েকটি মাছ জাল ছিঁড়ে বেরিয়ে এসে মুক্তির আনন্দ পায়। মানুষের মধ্যেও সেইরকম বদ্ধ, মুমুক্ষু ও মুক্ত—এই তিন রকম মানুষ দেখতে পাওয়া যায়।
কাঁচা মাটির পাত্র ভেঙ্গে গেলে কুমোর সেই মাটি আবার ব্যবহার করতে পারে। কিন্তু পোড়াবার পর পাত্রটি ভেঙ্গে গেলে তা দিয়ে আর কিছু করা যায় না। সেইরকম জ্ঞানহীন লোক মৃত্যুর পর আবার জন্মগ্রহণ করে। কিন্তু জ্ঞানাগ্নিতে পুড়ে খাঁটি হ’লে মানুষের আর পুনর্জন্ম হয় না। সিদ্ধ ধান পুঁতলে তার থেকে আর ধানের চারা জন্মায় না, কিন্তু সিদ্ধ না করলে ধান থেকে শীষ বেরোয়। সেইরকম মৃত্যুর আগেই সিদ্ধিলাভ করলে মানুষের পুনর্জন্ম হয় না। কিন্তু সিদ্ধিলাভ না হওয়া পর্যন্ত মানুষকে সংসারে ফিরে ফিরে আসতে হয়।
সিদ্ধপুরুষদের মধ্যে দু’টি থাক্‌ দেখা যায়। একটি থাক্‌ সত্যজ্ঞান লাভের পর আত্মানন্দে ডুবে থাকেন—এঁরা অন্যদের সম্বন্ধে সম্পূর্ণ উদাসীন। আর একটি থাক্‌ সত্যজ্ঞান লাভ ক’রে একা একা সে আনন্দ আস্বাদ করতে চান না, বরং চেঁচিয়ে সবাইকে বলেন,—“তোমরাও এসো, আমাদের সঙ্গে সত্যকে আস্বাদন করো”।
নুনের পুতুল, কাপড়ের পুতুল আর পাথরের পুতুল এই তিনটি পুতুলকে জলে ডুবিয়ে রাখলে প্রথমটি জলে গ’লে একাকার হয়ে যাবে, দ্বিতীয়টি দেখতে আগের মতো থাকলেও অনেক জল শুষে নেবে আর তৃতীয়টির জলে কিছুই হবে না। যাদের জীবাত্মা পরমাত্মার সঙ্গে মিলে এক হয়ে গেছে তারা হ’ল মুক্ত পুরুষ, প্রথম পুতুলটির মতো। যেসব প্রেমিক ভক্ত জ্ঞান ও স্বর্গীয় আনন্দে ভরপুর তারা দ্বিতীয় পুতুলের মতো। সংসারীরাহ’ল তৃতীয় পুতুলটির মতো যাদের অন্তরে সত্যজ্ঞান কোনরকমেই ঢুকবে না।

ধন্যবাদ



    

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ