বীর সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ
বহুমাত্রিক এক ব্যাক্তিত্বের নাম বিবেকানন্দ
মহান ধর্মগুরু |
"One infinite pure and holy - beyond thought beyond qualities I bow down to thee " অর্থাৎ "প্রণাম করি সেই একক,অনন্ত,শুদ্ধ ও পবিত্র - চিন্তা ও গুনের অগম্য ঈশ্বরকে "।
অজস্র ভাবে ও ভূমিকায় তিনি আবির্ভূত - নেতা,ধর্মগুরু,আচার্য,দার্শনিক, ঐতিহাসিক,দেশপ্রেমিক, সাংবাদিক, সমাজতাত্ত্বিক,সাহিত্যিক,রসিক,গায়ক, দরদি বন্ধু,মজলিশি আড্ডার মধ্যমণি, ক্রীড়াবিদ এবং সর্বশেষে ও আদ্যান্ত প্রেরণাদীপ্ত ঈশ্বর পুরুষ।।
স্বামীজীর ব্যক্তিত্বের সেই বর্ণালী প্রত্যক্ষ করে পাঠকের মনশ্চক্ষের যে তৃপ্তি হবে, তেমনি তার হৃদয় ও মস্তিষ্কের জগতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠবে বিবেকানন্দ নামক বিশ্বপথিক ও বিশ্ব প্রতিভার নব নব দিগন্তও। সেই কারনেই আজ আমার এই লেখা। প্রিয় বন্ধুরা আমার এই লেখাটি আপনারা মনোযোগ সহকারে পড়িলে আমার এই লেখাটি স্বার্থক হবে।
* * * * *
স্বামী অখন্ডানন্দ স্বামীজি সম্পর্কে কি বলেছেন শুনুন
বেলুড়ে একদিন তখনো রাত আছে, উঠে পড়েছি।উঠেই স্বামীজীকে দেখতে ইচ্ছে হলো।স্বামীজীর ঘরের দরজায় গিয়ে আস্তে আস্তে টোকা দিচ্ছি,ভাবছি স্বামীজী ঘুমোচ্ছেন।উত্তর না আসলে আর জাগাবো না।স্বামীজী কিন্তু জেগে আছেন - ঐটুকু টোকাতেই উত্তর আসছে গানের সুরে...
"Knocking knocking who is there?
Wating wating Oh brother dear!"
* * *
স্বামীজীর কথা কি বলব?তার কাছে আমি এতোটুকু। মঠে এমন দিনও গেছে যে আলোচনা করতে করতে রাত দুটো বেজে গেছে স্বামীজি বিছানায় শোননি, চেয়ারে বসেই বাকি রাতটা কাটিয়েছেন।আমাদের সকলের আগে উঠে প্রাতঃকৃত্যাদি সেরে জামাটা পরে গঙ্গার ধারে পূর্বদিকের বারান্দায় বেড়াচ্ছেন।
আমি চিরকালই ভোরে উঠে - অতি ভোরে উঠে দেখি তিনি ঐরকম বেড়াচ্ছেন। স্বামীজীর গর্ভধারিণীর মুখে শুনেছি বালককালের এবং বড় হয়েও কখনো বেলা অব্দি ঘুমান নি।,কখনো নয়;অতি ভোরে উঠতেন।
মঠে স্বামীজি ভোরে উঠে ঠাকুর ঘরে গিয়ে ধ্যান করার নিয়ম বেঁধে দিয়েছিলেন।নিজেও আমাদের সঙ্গে গিয়ে ধ্যান করতেন। স্বামী এিগুনাতীতেরর চারদিন জ্বর; জল সাবু খেয়ে আছেন। স্বামীজী ধ্যান করতে ঠাকুর ঘরে যাবার সময় তাকেও ডাকলেন বললেন ওরে আয়, জ্বর - তার আর কি? ধ্যান করবি চল।তোরা যদি জ্বর হয়েছে বলে ধ্যান না করিস- লোকে তোদের দেখে কি শিখবে? বলে তাকে সঙ্গে করে ঠাকুর ঘরে নিয়ে গেলেন।
আর একদিনের কথা। মঠ তখনও নীলাম্বর মুখুজ্যের বাগানে। একদিন দুটো পর্যন্ত বেদ- বেদান্ত আলোচনা হয়েছে।পুনর্জন্ম আছে কিনা - মানবাত্মার অধোগতি হয় কিনা। স্বামিজি তর্ক লাগিয়ে দিয়ে মধ্যস্থ হয়ে চুপ করে হাসছেন। আর যে পক্ষ পারছে না তাদের নতুন যুক্তি দিয়ে উস্কে দিচ্ছেন।দুটোর পর আলোচনা ভেঙে দিলেন।তারপর সব ঘুম।চারটে বাজতে না বাজতেই স্বামীজী আমাকে তুলে দিলেন- দেখলুম এর মধ্যেই তিনি সব সেরেসুরে পায়চারি করছেন। আর গুনগুন করে গান গাইছেন।আমায় বললেন লাগা ঘন্টা; সব উঠুক, শুয়ে থাকা আর দেখতে পারছি না।" আমি তাও একবার বললুম এই দুটোর সময় সব শুয়েছে, ঘুমোক না একটু।স্বামীজি কঠোর স্বরে বলছেন, "কি, দুটোর সময় শুয়েছে বলে ছটা সময় উঠতে হবে নাকি? দাও আমাকে, আমি ঘন্টা দিচ্ছি - আমি থাকতেই এই!ঘুমোবার জন্য মঠ হলো নাকি?"
তখন আমি খুব জোরে ঘন্টা দিলাম।সব ধড়মড় করে উঠেই চিৎকার,"কে রে,কে রে?" আমায় বোধহয় ছিড়েই ফেলত কিন্তু দেখে আমার পিছনে স্বামীজি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাসছেন।তখন সব উঠে পড়ল।
* * * *
মহাযোগী |
স্বামীজি মহা বুদ্ধিমান ছিলেন। তার রাগ একেবারেই ছিল না। তিনি ' অক্রোধপরমানন্দ ছিলেন।রাজপুতনায় গেছি।সেখানে নাপিত আমায় কামাচ্ছে আর বলছে "মহারাজ,আপনাদের স্বামীজীর তুলনা নেই। আমরা মূর্খ তার পাণ্ডিত্যের বিষয় কি বুঝবো?অমন ক্রোধ সংবরণ করতে কাউকে দেখিনি।পণ্ডিতেরা তাকে বিচারে পরাস্ত করতে এসেছে,অপমানসূচক উত্তর দিচ্ছে - আর তিনি মুচকি হাসতে হাসতে তার প্রত্যুত্তর দিচ্ছেন।শেষে যারা তার নিন্দা করতে এসেছিল তারাই তার গোলাম হয়ে গেল।"
কোন বিষয় শিক্ষা করতে গেলে আমাদের মনে হতো না,ও আমার চেয়ে বয়সে ছোট,ওর কাছে কি শিখবো? স্বামীজীর মতো পন্ডিত,তিনিও খেতড়িতে নারায়ণ দাস এর নিকট পাণিনি পড়তে আরম্ভ করলেন।খেতড়িতে তার চেয়ে সম্মানের যোগ্য কে ছিলো?রাজার গুরু বলেও বটে, আবার নিজের ত্যাগ তপস্যা পাণ্ডিত্যও বটে। তিনি আমায় বলেছিলেন "নারায়ন দাসের কাছে ছাত্রের মতন পড়া শুরু করে দিলাম।" মন একাগ্র হলে বাহ্য জগৎ এর সম্বন্ধ লোপ হয়ে যায়।স্বামীজীর এই অবস্থা হতো। যখন রাজেন্দ্র মিত্রের লেখা বৌদ্ধযুগের ইতিহাস পড়তেন,তখন কিছুক্ষন পড়ার পর বই পড়ে থাকত।তার মন এক অজ্ঞাত রাজ্যে চলে যেত।স্বামীজি বলতেন " ঘর,বাড়ি,বই,চেয়ার, বেঞ্চ সব উড়ে যেত - কিছুই নেই - এক অনন্ত রাজ্যে আমার সত্তা হারিয়ে যেত।" শঙ্করাচার্য ও বুদ্ধদেবের এই অবস্থা হতো।
স্বামীজীর ভীষণ রসিক পুরুষ ছিলেন।হঠাৎ একদিন ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দের কথা।স্বামীজীর সঙ্গে দার্জিলিং-এ আছি।সকালে দেখি - একেবারে গম্ভীর,সারাদিন কিছু খেলেন না, চুপচাপ।ডাক্তার ডেকে আনা হলো,কিন্তু তার রোগ নিরূপণ করতে পারলেন না।একটা বালিশে মাথা গুঁজে বসে রইলেন সারা দিন। তারপর শুনলাম কলকাতায় প্লেগ - তিন ভাগ লোক শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছে - শুনে অবধি এই ! সেসময় স্বামীজি বলেছিলেন, সর্বস্ব বিক্রি করেও এদের উপকার করতে হবে।আমরা যে গাছ তোলার ফকির সেইখানেই যাব।
স্বামীজীর কি প্রাণ !তার শতাংশের একাংশ আমাদের কারো নেই? আমরা তো তার গুরুভাই, অন্যের কা কথা। দেশের দুঃখ কষ্টের কথা বলতে বলতে স্বামীজি কেমন হয়ে যেতেন। আমি তখন তাকে জিজ্ঞাসা আমি তখন তাকে জিজ্ঞাসা করতাম, ভাই, "কেন দেশ জাগছে না?" তার উত্তরে তিনি বলতেন, " ভাই এ যে পতিত জাত! এদের লক্ষনই এই।" আহা স্বামীজীর তুলনা নেই
* * * * *
স্বামী যখন যে ভাবের উপর জোর দিতেন, তখন মনে হতো সেটিই সত্য এবং একমাত্র সত্য। মঠে প্রায় এরকম হতো। তাই হঠাৎ কেউ এসে তার ভাব ধরতে পারতো না। যেদিন সেবা ধর্মের কথা উঠল সেদিন এমন বললেন যে মনে হল - নিষ্কাম কর্ম - যোগই একমাত্র পথ - আর সব মিথ্যা, ভুল। যেদিন শাস্ত্র পাঠ কি ধ্যান ধারণার কথা উঠল সেদিন আবার আর এক ধরন,মনে হতো জ্ঞানের পথ বা ধ্যানের পথই পথ, আর সব বাজে কাজ। সেদিন স্বামীজীকে মনে হতো - বুঝিবা সাক্ষাৎ শংকর অথবা বুদ্ধ।আর যেদিন তিনি রাধারানী, গোপীভাব বা প্রেম ভক্তির কথা বলতেন সেদিন তিনি সম্পূর্ণ আর একটি মানুষ, বলতেন : Radha was not of flesh and blood. She was a froth in the ocean of Love. ( শ্রীমতি রাধা রক্তমাংসের নয়,তিনি প্রেম সমুদ্রের একটি বুদবুদ !)
একথা তার মুখে বহুবার বলতে শুনেছি; হয়তো আপন-মনে বলেছেন আর জোরে জোরে পায়চারি করছেন। অথচ সাধারণত কেউ রাধাকৃষ্ণ বা গোপীপ্রেম আলোচনা করলে থামিয়ে দিতেন,বলতেন, " শংকর পড়, শিবের ভাবে ভরে যাও।" ত্যাগ, জ্ঞান, ধ্যান, কর্ম - এগুলি উপরই জোর দিতেন।
* * * * *
স্বামীজীর সঙ্গে হিমালয় ভ্রমণের সময় এক জায়গায় স্বামীজি গেলেন বনের পথ দিয়ে, আমাকে বললেন একটু ঘুরে যেতে; কিছু দূরে গিয়ে দেখি স্বামীজীর সঙ্গে দেখা। দেখি স্বামীজী একা - কিন্তু হাসছেন,কার সঙ্গে যেন কথা কইছিলেন,চোখেমুখে কি এক আনন্দের ভাব !জিজ্ঞাসা করলাম " ভাই কার সঙ্গে কথা কইছিল?" তিনি চুপ করে শুধু মুখ টিপে হাসতে লাগলেন।
স্বামীজিও আমি একসঙ্গে যেতে যেতে পাহাড়ে এক জায়গায় দেখি এক সাধু ধ্যান করতে বসেছে- বেশ কাপড়-চোপড় মুড়ি দিয়ে মাথা পর্যন্ত, আর সজোরে নাক ডাকাচ্ছে। স্বামীজী চেঁচিয়ে উঠেছেন, "ওরে ব্যাটা বসে বসে ঘুমোচ্ছে- দে বেটার কাঁধে লাঙ্গল জুড়ে।তবে যদি এর কোনো কালে কিছু হয়।"
এইসব দেখে শুনে তিনি বলতেন "সত্বের ধুয়া ধরে দেশ তমঃ সমুদ্রে ডুবতে বসেছে, এদের বাঁচাতে হলে চাই আপাদমস্তক শিরায় শিরায় বিদ্যুৎ সঞ্চারী রজোগুণ।"তাইতো কর্মের উপর এত জোর !
পরোপকারে কার উপকার? আমার নিজের- এইতো স্বামীজীর কর্মযোগ - সেবাধর্ম। সেবায় চিত্তশুদ্ধি, সেবায় হৃদয়ের বিস্তার, সেবায় সর্বভূতে আত্মদর্শন। আত্মজ্ঞান হলে পরে বিশ্বপ্রেম।তখন বোঝা যায় সেই অনুভূতি -
' ব্রহ্ম হতে কীট পরমাণু - সর্বভূতে সেই প্রেমময় !'
বহুরূপে সম্মুখে তোমার ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর?জীবে প্রেম করে যেইজন সেইজন সেবিছে ঈশ্বর।'
জীবসেবা শিবসেবা। জীব আর আছে কে?- সবই তো শিব !
এ যুগে ঠাকুর স্বামীজীই প্রত্যক্ষ দেবতা! ঠাকুর যে সাক্ষাৎ ভগবান এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।স্বামীজীর দেখা পাওয়া সহজ, তিনি দেখা দেওয়ার জন্য সর্বদা ব্যাকুল ! ঠাকুর কিন্তু এতসহজ নয়।
এ যুগের লোক স্বামীজীর ভেতর দিয়েই ঠাকুরকে বুঝবে।এই জন্য লোকে স্বামীজীর ভাব আগে নিচ্ছে।এইসব সেবাকর্ম, রিলিফ, দেশপ্রেম - এর ভেতর দিয়েই field ( ক্ষেত্র) তৈরি হবে,চিত্তশুদ্ধি হবে।তারপর Spiritual ( আধ্যাত্মিক ) - সবে তো জীবসেবা আরম্ভ প্রেম এখনো বহুদূর !
~Hand,Head, and Heart ( হাত মস্তিষ্ক ও হৃদয় )তিনটিরই চর্চা করতে হবে - স্বামীজীর ভিতরে তিনটিই ফুটে ছিল,আমাদের চেষ্টা করতে হবে প্রথমটি থেকে।স্বামীজীর মত Spiritual (আধ্যাত্বিক )আমরা না হতে পারি- তার মতো Heart and Intellect ( হৃদয় ও বুদ্ধি না থাকতে পারে কিন্তু হাতের কাজটা দিক দিয়ে তো আমরা তার অনুসরণ করতে পারি।মঠে তিনি এত বড় হাণ্ডা মেঝেছিলেন,এক ইঞ্চি পুরু ময়লা। আমরা কি একটি বাটিও পরিষ্কার করতে পারি না?
তিনি মঠের পায়খানা পরিষ্কার করেছেন! একদিন গিয়ে দেখেন খুব দুর্গন্ধ - বুঝতে আর বাকী রইলনা - গামছাটা একটু মুখে বেঁধে দুহাতে বালতি নিয়ে যাচ্ছেন, তখন সব দেখতে পেয়ে বলে "স্বামীজী আপনি!" স্বামীজি,হাসি হাসি মুখে, বলছেন,"এতক্ষণে স্বামীজি আপনি !!"
আমি হলেন Principle - এর ( উচ্চনীতির) একটি প্রতিমূর্তি! তিনি রক্ত মাংসের তৈরি ছিলেন না - idea(ভাব) দিয়ে গড়া।তিনি রাধা সম্বন্ধে যেমন বলতেন, Radha was a forth in the Ocean of Love. She was not of flesh and blood' - তেমনি তিনিও! principle (নীতি )বড়ো ভয়ানক জিনিস! তার জন্য সব ত্যাগ করতে হয়। principle-ই তো idea ( নীতিই তো আদর্শ)।
মহান দেশপ্রেমিক |
স্বামীজীর দেশপ্রেম অত সোজা নয়।এ patriotism নয় - এ দেশাত্মবোধ। সাধারন লোকের হচ্ছে দেহাত্মবোধ।তাই দেহের সেবাযত্নে বিভোর। তেমনি স্বামীজীর হচ্ছে দেশাত্মবোধ।তাই সারাদেশের সুখ-দুঃখ ভুত- ভবিষ্যৎ- নিয়ে তার চিন্তা। দেশাত্মবোধ তার শেষ নয়,আছে বিশ্বাত্মবোধ। জগতের সকল জীবের জন্য চিন্তা - তাদের ভক্তি মুক্তি কি করে হবে - সেও তার চিন্তা; সবার মুক্তি না হলে তার মুক্তি নেই।
স্বামীজী শেষ দিকটাই মানুষের সংস্রব একরকম ছেড়েই দিয়েছিলেন। মঠে একপ্রকার চিড়িয়াখানা করেছিলেন- চিনে হাঁস, রাজহাঁস, পাতিহাঁস নানা রকমের পায়রা, কুকুর,বেড়াল,সারস,ভেড়া ইত্যাদি পুষেছিলেন।তাদের যত্ন করে খাওয়াতেন, আদর করতেন।একদৃষ্টে সস্নেহে তাকিয়ে থাকতেন। শ্রীকৃষ্ণ গোধন নিয়ে কি রকম খেলা করতেন - এই দৃশ্য দেখলে তার অনেকটা ধারণা হয়। তখন স্বামীজীর মুখ চোখের ভাব কি অদ্ভুত রকম বদলে যেত - তা আর কি বলব ! একেই বলে জীবে প্রেম,বিশ্বপ্রেম।
0 মন্তব্যসমূহ