জীবনের মূল মন্ত্র ও সাধনা




জীবনের মূল মন্ত্র ও সাধনা -   ( The main mantra and pursuit of life )    বৈষ্ণবের ভাবের সাধন গুলি খাঁটি বেদান্তের উপর প্রতিষ্ঠিত। বৈষ্ণবের ভাব সাধন বড়ইমধুর।এগুলী জগতের স্বাভাবিক উপাদান। এই স্বাভাবিক  ভাবগুলী ভগবানে আরোপ করতে পারলে অর্থাৎ ভগবানের জন্য এমনি সহজভাবে সাধনা করতে পারলেই জীবন সার্থক |


sadhana

SADHANA


শ্রীভগবানুবাচ’ বলিয়া কথার সূচনা করিলেন শ্রীমান্‌ উদ্ভব। অন্তরের আশয় এই যে, হে গোপরামাগন, শ্রীকৃষ্ণের বার্তা আমি নিবেদন করিব আপনাদের কাছে অবিকৃত অক্ষরেই। যাহা তিনি বলিয়াছিলেন ঠিক তাহাই বলিব “তত্তদক্ষরেণৈব।” যদি তাঁহার বাক্যের ভাব গ্রহন করিতে পারিতাম, তাহা হইলে তাঁহার বাহনভাষাকে এক আধটু ওলট পালট বলিলেও চলিতে পারিত। কিন্তু ভাব গ্রহনে আমি সম্পূর্ণ অক্ষম যে বাণীর, তাহার অক্ষর বদলাইবার দুঃসাহস আমার নাই। আমি তাঁহার কথাগুলি বহন করিয়া আনিয়াছি বটে, কিন্তু পত্রবাহক যেমন পত্রের শিরোনামাই দেখে, আমিও সেইরুপ উপরটাই দেখিয়াছি, ভিতর কি তাৎপর্য্য তাহা লেখক জানেন আর আপনারা হয়ত বুঝিবেন। “নাহং বিবেক্তুং শকনোমি,” কিন্তু ভবত্য এর বিচারয়ন্ত্বিতি—শ্রীসনাতন

শ্রীকৃষ্ণের প্রথম বাণী— আপনাদের নিকট প্রেরিত প্রথম সন্দেশ এই -

“ভবতানাং বিয়োগো মে ন হি সর্ব্বাত্মনা কচিৎ।”

শ্রীহরির উক্তিটি অতি ছোট, মাত্র একটি কথা—“সর্ব্বাত্মক আমার সঙ্গে আপনাদের কোন বিরহ হইতে পারে না।” কিন্তু এই এতটুকু কথার তাৎপর্য্য অতি গভীর।
শ্রীমান্‌ উদ্ধব শ্রীকৃষ্ণের সংবিৎ-শক্তির মূর্তি—জ্ঞান-প্রধান। তিনি শ্রীকৃষ্ণের বাক্যকে জ্ঞানপর বুঝিয়াছেন। গোপিকাগণ শ্রীকৃষ্ণের হলাদিনীশক্তির মূর্ত্তি—প্রেম-প্রধান। তাঁহারা প্রাণদয়িতের বাণীকে রসপ্রাধান্যে গ্রহণ করিয়াছেন। বাণীর প্রেরক স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ নিজে নিত্যকাল যে শক্তিতে নিত্যলীলায় স্থিত, সেই সচ্ছক্তি বা সন্ধিনী-প্রধান নিত্যলীলার অর্থে উহা প্রেরণ করিয়াছেন।
কথাটির তিন প্রকার অর্থ। যেটি শ্রীকৃষ্ণের অন্তরে সেটি সৎপ্রাধান্যে সন্ধিনীসেবিত। যে অর্থ উদ্ধব গ্রহণ করিয়াছেন সেটি চিৎপ্রাধান্যে সংবিৎসেবিত। যে অর্থ ব্রজরামাগণ গ্রহণ করিয়াছেন সেটি আনন্দপ্রাধান্যে হলাদিনীসেবিত। আমরা প্রথমে তিনটি অর্থেরই কিঞ্চিৎ অনুধ্যান করিব। পরে ব্রজাঙ্গনাগণের গৃহীত অর্থেরই অনুসরণ করিব। তিন প্রকার অর্থের আলোচনার প্রথমে উদ্ধবগৃহীত অর্থ, তৎপর গোপীভাবিত অর্থ ও তদনন্তর শ্রীকৃষ্ণপ্রেষিত অর্থের আস্বাদন করিব। শ্রীশুকের করুণা ছাড়া ইহার মধ্যে প্রবেশ করিবার উপায়ান্তর নাই।
শ্রীকৃষ্ণ বলিয়াছেন, “সর্ব্বাত্মক আমার সঙ্গে আপনাদের কোন বিয়োগ হইতে পারে না।” এই কথায় উদ্ধব বুঝিয়াছিলেন যে শ্রীকৃষ্ণ সর্বাত্মা। উপাদানরূপে ও অন্তর্য্যামিরূপে তিনি নিখিল বিশ্বের সর্ববস্তুতে ও সর্বব্যক্তিতে অনুস্যূত আছেন। সুতরাং তিনি গোপীগণের মন প্রাণ বুদ্ধি ইন্দ্রিয় যাহা কিছু সকলের আশ্রয়রূপে চিরবিরাজমান আছেন। অতএব তাঁহারসহিত ইহাদের এক মুহূর্তের জন্যও বিরহ হইতে পারে না। দৃষ্টান্ত দিয়া বলিয়াছেন, আকাশ যেমন পৃথিবীর প্রত্যেক অণু-পরমাণুতে অনুগতরূপে বিদ্যামান, তিনিও সেইরূপ সকলের আত্মায় অনুপ্রবিষ্ট। আত্মার আত্মা বলিয়া শ্রীকৃষ্ণ সর্বাত্মক। সুতরাং তাঁহার সহিত কাহারও বিয়োগ হওয়ার সম্ভাবনা নাই। সর্বদাই সকল বস্তুর সঙ্গে তাঁহার যোগ রহিয়াছে। বিয়োগ যেখানে নাই, বিরহের সেখানে নাই, বিরহের সেখানে সম্ভাবনা কোথায়? উদ্ধব ‘সর্ব’ অর্থে বুঝিয়েছেন বিশ্বের যাহা কিছু, আত্মা-পদে বুঝিয়াছেন পরমাত্মা। উদ্ধব ঠিকই বুঝিয়াছেন। জ্ঞানবাদের মতে পরমাত্মার সহিত কাহারও বিরহ হইতে পারে না। এইবার দেখিব গোপীগণ শ্রীকৃষ্ণের এ বাক্য কী অর্থে গ্রহণ করিলেন। “ভবতীনাং বিয়োগো মে ন হি সর্বাত্মনা ক্কচিৎ।’


ভাবের সাধনা ও বেদান্ত 


বৈষ্ণবের ভাবের সাধনাগুলি খাঁটী বেদান্তের উপর প্রতিষ্ঠিত। সখীভাবে যারা সাধন করে, তারা ক্রমে সখীতে মিশে যায়—তখন তাদের সগুণ-নির্গুণব্রহ্মাত্মক রাধাকৃষ্ণের যুগলমূর্ত্তি দর্শন হয়। সখীই বেদান্তের সাক্ষী চেতা। সখীভাবে সাক্ষীস্বরূপে থেকে সমস্ত ব্রহ্মাণ্ডে রাধাকৃষ্ণের যুগলমূর্ত্তি দেখা যায়। পঞ্চভাব হতেও গোপীভাব শ্রেষ্ঠ। তা বেদান্তের “সাক্ষী চেতা নির্গুণশ্চ” এই ভাব। গোপীর নিজের কোন কামনাই নাই, সে চায় কৃষ্ণকে এনে রাধার সঙ্গে মিলিয়ে দিয়ে সেই যুগল-মিলন দেখবে। তার নিজের সুখাবাঞ্ছা নাই, রাধাকৃষ্ণের মিলনানন্দেই তার আনন্দ, তাই গোপীই সর্ব্বশ্রেষ্ঠ আনন্দের অধিকারী; যুগল-মিলনের সমষ্টিগত আনন্দই সাক্ষীভাবে গোপী অনুভব ক’রে থাকে, অথচ সে নির্লিপ্ত। এই তো বেদান্তের চরম সিদ্ধি। জীবাত্মাকে পরমাত্মায় মিলানো কিম্বা প্রকৃতি-পুরুষের সংযোগ—এই সবই রাধাকৃষ্ণের যুগল মিলন। এই মিলন দেখাই গোপীভাব বা সাক্ষীভাব। বেদান্তের দ্বারা বৈষ্ণবের ভাব-পথ ঠিক ক’রে নিলেই সবচেয়ে মধুর হয়, তখন আর কোনও ভুল থাক্‌তে পারে না।

যতক্ষণ পর্য্যন্ত প্রার্থনা থাক্‌বে, ততক্ষণ পর্য্যন্ত অদ্বৈত-জ্ঞান হবে না—ও হল দ্বৈতভাব। কিন্তু চৈতন্যদেবপ্রর্ত্তিত ভাবের সাধনা অদ্বৈতমূলক। ভাব-সাধনা খাঁটী বেদান্তের উপর প্রতিষ্ঠিত—কেননা ভাবের সাধনায় আমির সঙ্কীর্ণ অস্তিত্ব লোপ হয়ে ভাবের আকারে তার প্রতিষ্ঠা হয়।

হিন্দুর বেদান্ত প্রত্যক্ষ এবং জাগ্রত; এর মত মধুর আর কিছুই নাই। বেদান্ত-জ্ঞান হলেই প্রকৃত প্রেমিক হওয়া যায়, ভাবের সম্যক্‌ বিকাশ তখনই হয়, কেননা ভাব তখন বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ে। ব্রহ্মাণ্ডের প্রতি অণুপরমাণুতে তার অনুভূতি হয়। বৈদান্তিক কৃষ্ণকে যেমন বোঝেন, ভক্তিপন্থীও তেমন বুঝতে পারেন না। যার বিষয় কিছু জান্‌লাম না, বুঝলাম না, শুধু শুধু কি তার উপর তেমন টান হয়? তা হয় না। জ্ঞানেই শ্রীকৃষ্ণতত্ত্ব ঠিক ঠিক বোঝা যায়। যখন সাধকের প্রতি অণুপরমাণুতে ইষ্টস্ফূর্ত্তি হয়, তখনই মধুরভাব। গোপীভাব সর্ব্বশ্রেষ্ঠ—উহাই বেদান্তের সাক্ষীভাব; উহাতে রাধা ও কৃষ্ণ উভয়েরই ভাব আস্বাদন হয়।

ভাবের সাধনা -

বৈষ্ণবের ভাবসাধন বড়ই মধুর, কারণ এগুলি জগতের স্বাভাবিক উপাদান। নিত্য যা চোখের সাম্‌নে ঘটছে, তা থেকেই ভাবগুলো নেওয়া হয়েছে। তাই ভাবের সাধনে বিরুদ্ধাচরণ আদৌ নাই—স্বভাবের অনুকূলেই ভাব-সাধনা। সন্ন্যাসাদি কঠোর সাধনাতেও স্বভাববিরুদ্ধ নিয়ম-সংযম করতে হয়, কিন্তু ভাবের সাধন স্বভাবানুযায়ী। জগতে যত রকম ভাবের বিকাশ আছে, সব নিয়েই বৈষ্ণব এক একটা সাধন-পথ তৈরী করেছেন। বিশেষতঃ ভাবগুলি ভগবানের নিত্য-জগতের জিনিষ, তাই এত মধুর। উৎকণ্ঠিতা, বিপ্রলব্ধা, সব তো এই জগতের স্বাভাবিক অবস্থা। এই স্বাভাবিক ভাবগুলি ভগবানে আরোপ করতে পারলে অর্থাৎ ভগবানের জন্য এমনি সহজভাবে সাধনা করতে পারলেই জীবন সার্থক।


বিরহ 

গোপীগণ বিরহের তাপে দগ্ধীভূত হইতেছেন। শ্রীকৃষ্ণ বক্তৃতা দ্বারা বলিতেছেন, তোমাদের সঙ্গে আমার বিয়োগ নাই। বিচার অপেক্ষা অনুভবের মূল্য সহস্রগুণ অধিক। অন্তরভরা বিরহ-বেদনার অনুভূতি, এই সময় বিচারমূলক ভাষায় বুঝাইয়া দেওয়া হইল-বিয়োগ কোথাও নাই। এই বিচারমূলক ভাষায় প্রাণ সিক্ত হয় না।
বিরহে স্ফূর্তিতে সাক্ষাৎকার বলিয়া মনে হয়। তাহা হউক, তাই বলিয়া বিরহ নাই এ কথা কী বলা চলে। হে জীবিত-বল্লভ! তুমি দূরে আছ ঠিকই আছ দূরে। এই জন্যই বেদনা। কেন দূরে আছ, কবে আসিবে, ইহাই মাত্র আমরা জানিতে চাহি। ইহারই উত্তর বলিতেছেন—

যস্ত্বহং ভবতীনাং বৈ দূরে বর্ত্তে প্রিয়ো দৃশাং মনসঃ সন্নিকর্ষার্থং মদনুধ্যানকাম্যয়া।

আমি দূরে আছি। সত্যই দূরে আছি। কেন আছি তাই বলি। কংসকে বধ করা, বসুদেব, দেবকী, উগ্রসেনকে মুক্তি দেওয়া—ইহা ছিল অবশ্য কর্ত্তব্য। এই কর্ত্তব্যবোধ ব্রজ হইতে মথুরায় আনিয়াছে আমাকে। কংস বধের পর অনেকগুলি দায়িত্ব আসিয়াছে, তথাপি ঐগুলি পরিত্যাগ করিয়া কিছুদিনের জন্য যে ব্রজ যাইতে পারি না, তাহা নহে। তবু যে তোমাদের নয়নপথ হইতে দূরে রহিয়াছি ইহার কারণ, আমার এইটি স্বভাব। এই স্বভাবটি হইল স্বজন-প্রেমবিবর্দ্ধন-পরায়ণতা। প্রেম বাড়ান স্বভাবটি আমাকেও দুঃখ দেয়, আমার নিজজনদেরও দুঃখ দেয়। এই দৈহিক বিরহের ইহাই কারণ।

মথুরায় আছি মাত্র। চিত্তে যে সুখ আছে তাহা নহে। “কেবলং বর্ত্তেন তু সুখেনাস্মীতি।” ব্রজে থাকাকালে তোমরা যখন তোমাদের নির্ম্মল দেহ মন আমাকে অর্পণ করিতে, তখন আমার সুখ হইতে অসীম, আবার লজ্জাও হইত ভীষণ “চেতসী সদৈব লজ্জাজায়ত ইতি।” কেন না, তোমাদের দেহ মনে স্বসুখ-বাঞ্ছা নাই বিন্দুমাত্র। আমার দেহে তাহা রহিয়াছে পূর্ণমাত্রাতেই। তোমাদের দেহ মন আমাতে একনিষ্ঠ, আমার দেহ মন তোমাদের বহুজনে বহুনিষ্ঠ। তোমাদের প্রীতি অব্যভিচারী, আমার প্রীতি ব্যভিচারী। সুতরাং মিলনকালে তোমাদের দিকে দৃষ্টি করিলে আমার হইত তীব্র লজ্জার উদয়। আমার অদর্শনে তোমাদের প্রতিটি ক্ষণ শতযুগতুল্য মনে হয়। উহা প্রত্যক্ষ দেখিয়া আমার মনে লালসা জাগিত, ঐরূপ আকুলতামাখা গাঢ় আবেগপূর্ণ অনুরাগ তোমাদের প্রতি আমার কিভাবে লাভ হইতে পারে।

বৃন্দাবনে অবস্থানকালে ঐরূপ ধ্যানের সুযোগ সুবিধা আমার কিছুতেই হইত না। তোমাদের সঙ্গে যখন মিলন হইত তখন থাকিতাম মিলনানন্দে। যখন বিরহ হইত তখন থাকিতাম সখাগণের বা জননীগণের সখ্য-বাৎসল্যরস-সাগরে ডুবিয়া। সুতরাং তোমাদের ধ্যান করিবার সময়ও হইত না, স্থানও পাইতাম না।
দেহ লইয়া দূর দেশে আসিয়াছি মথুরায়। এখন প্রচুর সময় ও স্থান মিলিয়াছে তোমাদের ধ্যান করিবার। “মনসঃ সন্নিকর্ষার্থং মদনুধ্যানকাম্যয়া”; মদনুধ্যান—মৎ-কর্ত্তৃকং যদুনুধ্যানং তৎকাম্যয়া তদ্ধেতোরেব।
তোমাদের প্রতি আমার প্রেম-বৃদ্ধি-কামনাতেই মথুরায় রহিয়াছি। দেহের নিকটবর্ত্তিতা না থাকায় মনের সন্নিকর্ষ লাভ হইতেছে “দৃকসমীপবর্ত্তিত্বেং, মনোদূরর্ত্তিত্ত্বং মনসমীপবর্ত্তিত্ত্বে দৃগদূরবর্ত্তিত্বং আসক্তিবিষয়ীভূতস্য বস্তুনো ভবতি— শ্রীবিশ্বনাথ।” মথুরায় তোমাদের নিরন্তর অনুধ্যানের কামনা পূর্ণ হইতেছে। মথুরাবাসী ভক্তেরাও আমায় ভালবাসে; কিন্তু তাহাদের ভালবাসায় ঐশ্বর্য্য মিশ্রিত থাকায় আমার মনের পূর্ণ আবেগ নাই। সুতরাং অনাসক্ত মন লইয়া তোমাদের ধ্যানের সুবিধা হইতেছে।


ভালবাসা


ভালবাসাতেই সুখ; তার আর প্রতিদানের আশা রাখতে নাই। শুধুই ভালবাসি—এই যার স্বভাব, সেই প্রকৃত সুখী। ভগবান্‌ সকল জীবকে সমান ভালবাসেন, জীব হতে কোনও রকম প্রতিদানের আশা রাখেন না। তাই ভগবানের সুখের মূল কারণ। এতেই তিনি সুখস্বরূপ, আনন্দস্বরূপ।
ভালবাসার লোক দূরে থাকলেও আনন্দ—তার স্মৃতিতে বা চিন্তাতেই কত আনন্দ। সতী স্ত্রীর স্বামী বিদেশে থাকলেও তার কথা মনে পড়তেই তার বুকখানা ফুলে ওঠে। আশে-পাশে কত পুরুষ ঘুরে বেড়ায়, কিন্তু কারু দিকে তো তার মন যায় না। ভগবান্‌কে তেমনি ভাল না বাস্‌তে পার্‌লে তাঁকে দেখ্‌লেও তেমন আনন্দ পাবে না। আর তাঁকে ভালবাসতে পারলে তাঁর দেখা না পেলেও তাঁর স্মৃতিতেই আনন্দ পাবে। টান ক্রমে বেশী হলে অবশেষে ভগবান্‌ দেখা দেবেন। তিনি সহজে ধরা দিতে চান না—ভক্তকে খাঁটী ক’রে তার পর আসেন।

মাতৃভাবের সাধনা

ভগবান্‌কে মাতৃ-ভাবে ভজনা করা যায়। মা সগুণব্রহ্ম। মাতৃ-ভাব মানে একটা স্ত্রী মূর্ত্তির চিন্তা নয়। মায়ের মত স্নেহ-আবদার ভগবানে আরোপ করাই মাতৃ-ভাব। ভগবানের সঙ্গে ওই রকম ব্যবহার কর্‌তে পার্‌লে তবে মাতৃ-ভাব সাধনা হবে, নতুবা একটি স্ত্রী মূর্ত্তি চিন্তা কর্‌লে আর কি হবে?
মা মা-ই; তাঁর কাছে আর যোগ-জপ-তপ কিছুই নাই। পার তো তাঁকে ভালবাস, তাঁর কাছে আবদার কর—তাঁর ইচ্ছায় ইচ্ছা মিশিয়ে তাঁর ওপর নির্ভর কর। এই হচ্ছে শ্রেষ্ঠ সাধনা।
জীব ও ভগবান
ভগবান্‌ বিশ্বপতি হলেও ডাক্‌লে আসেন। কেন আসেন? জীবকে সুখ দিতে। কেননা জীব অতি দুঃখী, অতি দীন, তাই তিনি দয়া কর্‌তে আসেন। নচেৎ তিনি যদি দণ্ডমুণ্ডের কর্ত্তা হয়ে নির্ব্বিকার হয়ে থাক্‌তেন, তবে তাঁর জন্য জীবের প্রাণ কেন ব্যাকুল হবে। জলের নীচে কলসী ডুবিয়ে রাখ্‌লে যেমন হয়, আমরাও তেমনি ভগবানের মাঝে ডুবে আছি। কিন্তু পাত্রের সুখ-দুঃখের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে বদ্ধ হয়ে আছি। বাস্তবিক আমাদের উপাদান তো ভগবান্‌ হতে ভিন্ন নয়। আমরা ব্রহ্মময়ীর সন্তান, আমাদের নিরানন্দ কেন আস্‌বে? আমরা যে আনন্দের উৎস। ভগবান্‌ জীবকে সর্ব্বদাই পরীক্ষা করেন, দেখেন, তাঁকে ছাড়া অন্য কোনও বস্তুতে ওর আকর্ষণ হয় কি-না। যদি বাজে জিনিষে ভুলিয়ে দিতে পারেন, তাহলে আর নিজেকে দেন না। সহজে তিনি ধরা দিতে চান না। যদি সাধক কোনও প্রলোভনেই মুগ্ধ না হয়, তাহলে অগত্যা ভগবান্‌ নিজে এসে সাম্‌নে দাঁড়ান। যার যে জায়গায় দুর্ব্বলতা আছে, তিনি এসে সেই জায়গাটাতেই আগে ধরেন।




সুখ বা আনন্দ কি?


সুখ বা আনন্দ কি, এটি বোঝার জন্যেই ঠাকুর রূপোর গড়গড়ায় তামাক খেয়েছিলেন, পেঁয়াজ মুখে দিয়ে এদিক-ওদিক করেছিলেন। ঘটনা দুটির মধ্যে গভীর তাৎপর্য রয়েছে। ঠাকুর আমাদের এর মাধ্যমে সচেতন করতে চেয়েছেন, আমরাও যেন সুখ কি তা নিয়ে বিচার করি। অধিকাংশ মানুষই পৃথিবীতে সুখের সন্ধানে ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু ‘সুখ’ বিষয়টি কি? একটি মানসিক অনুভূতি। মানুষ মনে করে এ-জিনিসে বা ঐ-জিনিসে সুখ আছে। এই ভেবে সে কতকগুলি জিনিস চায় এবং সেগুলি পেলে নিজেকে সুখী বলে মনে করে। কিন্তু যারা অনেকে পেয়েছে, যাদের টাকা-বাড়ী-গাড়ির অভাব নেই, তারাও সম্পূর্ণ সুখী বলে নিজেদের মনে করে না; তারা মনে করে যা চাই তার সব এখনো পাওয়া হয় নি। মানুষের হাহাকার কমে না। কেন? কারণ, মানুষ সুখ চায়, কিন্তু ‘সুখ’ কী তা নিয়ে কখনো চিন্তা করে না; তার মন সত্যি কি চাইছে, তা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করে না।

রসগোল্লা খেয়ে বাঙালিরা আনন্দ পায়, অথচ তামিলিরা রসগোল্লা খেতে ভালোবাসে না। গুজরাটিদের প্রিয় খাবার শ্রীখন্‌ড্‌ বাঙালিদের কাছে প্রিয় নয়। সিগারেট খেয়ে ছেলেরা আনন্দ পায়, কিন্তু অধিকাংশ মেয়েই এটিকে অপছন্দ করে। সুখ বা আনন্দ যদি রসগোল্লা-শ্রীখন্‌ড-সিগারেটে থাকতো, তবে সকলেই এগুলি খেয়ে আনন্দ পেতো। রসগোল্লায় কিন্তু মিষ্টি আছে; যে এটি খেতে ভালোবাসে আর যে অপছন্দ করে, সবাই এ-কথা বলবে। অর্থাৎ বলতে চাইছি, রসগোল্লায় যেমন ‘মিষ্টি’ আছে, লঙ্কায় যেমন ‘ঝাল’ আছে কাঁচা আমে যেমন ‘টক’ আছে, তেমনি ‘সুখ’ বা ‘দুঃখ’ কোনো জিনিসে নেই। আবার দেখুন, যে বিষয়টি আজ আমাদের আনন্দ দিচ্ছে, সেটি সবসময়ই আনন্দ দিতে পারে না। খুব ছোটবেলায় লজেন্‌স বা গ্যাস-বেলুন কিনে আনন্দ পেতাম, একটু বড় হয়ে ট্রাই-সাইকেল চড়ে আনন্দ পেতাম, আরো বড় হয়ে ঘুড়ি বা ফুটবলে আনন্দ পেতাম, পরে সিনেমা দেখে সুখী হতাম, তারপর পলটিক্‌স করে, এবং আরো বড় হয়ে সিরিয়াস বই পড়ে আনন্দ পাচ্ছি। তবেই দেখুন, মানুষের কাছে সুখের ধারণাটা কেমন বদলে-বদলে যায়। তাছাড়া শিশুর সুখ আর বৃদ্ধের সুখ, পুরুষের সুখ আর নারীর সুখ, সৈনিকের সুখ আর বৈজ্ঞানিকের সুখ—সুখ বা আনন্দ সম্বন্ধে মানুষের ধারণায় কত বৈচিত্র্য।

আসলে ‘সুখ’ ব্যাপারটির বিরাট অংশ জুড়ে আছে মানুষের নিজস্ব কল্পনা। মানুষের মন কতকগুলি বিশ্বাস (beliefs) ও অভ্যাসের (habits) দ্বারা নিয়মিত (conditioned)। খাওয়া-দাওয়া তথা জীবনযাত্রায় সে কতকগুলি অভ্যাসে অভ্যস্ত হয়েছে এবং কতকগুলি বিশ্বাস তার মনে গভীরভাবে বসে গেছে। এই সব মিলিয়ে গড়ে ওঠে সংস্কার (impressions)। এভাবে তার শরীর ও মন বিশেষ বিশেষ প্রথা ও কার্য-কারণে কনডিশন্‌ড বা শর্তাধীন হয়ে পড়েছে। এই শর্তাধীন অবস্থার পেছনে কাজ করছে তার পারিবারিক ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, শিক্ষা, পরিবেশ ইত্যাদি। এইসব মিলে ফলশ্রুতি (resultant) হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে তার রুচি বা মানসিকতা। তার শরীর-মনের কনডিশনিংয়ের সঙ্গে যে বিষয়গুলি একমুখী (in unison) হয়ে পড়ে, সেই বিষয়গুলিতে সুখ আছে বলে মনে করে। ঐ বিষয়গুলি পেলে তার মনে বিশেষ ধরনের বৃত্তি জেগে ওঠে এবং ঐ বৃত্তি যখন তার শরীর-মনের কনডিশনিংয়ের সহযোগী হয়, তখনই সে নিজেকে সুখী মনে করে। এভাবেই মানুষ বিশেষ বিশেষ বিষয়ে আসক্ত হয়। এখন প্রশ্ন—‘আসক্তি’র চেহারাটা কেমন? কেউ লজেন্স খেতে ভালোবাসে, কেউ ভালোবাসে সিনেমা দেখতে, কেউ তাস খেলতে। এই আসক্তির দুটি দিক। প্রথমটি বিষয়গত (Objective)—যেমন লজেন্স, সিনেমা, তাস। দ্বিতীয়তটি ভাবগত (subjective)—অর্থাৎ সুখের বৃত্তি। আরেকটু পরিষ্কারভাবে বলা যাক। পাড়ায় যখন মাইকে হিন্দি গান চলে তখন আপনি বিরক্ত হন, কিন্তু প্যাণ্ডেলে যারা রেকর্ড চালাচ্ছে তারা আনন্দ পায়। আপনি শুধুই গানটি শুনছেন, কিন্তু ওরা (যারা রেকর্ড চালাচ্ছে) যখন গানটি শুনছে তখন ঐ গানটি যে সিনেমার, সেই সিনেমার বিশেষ দৃশ্যটি (অর্থাৎ যে নাচের সঙ্গে ঐ গানটি হচ্ছিল সেই নাচের দৃশ্যটি) তাদের মনে ভেসে উঠছে। যদিও গান ও সিনেমার দৃশ্য আলাদা (এ দুটির শুটিং আলাদা ভাবে করে পরে জুড়ে দেয়ো হয়েছে), তবুও ঐ ছেলেরা গান শুনে সিনেমার দৃশ্যটি মনে মনে দেখছে; কারণ আগে যখন তারা সিনেমাটি দেখেছিল, তখন তাদের মনে ঐ দৃশ্য ও গানটি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে গেছে।

আসক্তি


 যে-সকল মূঢ়ব্যক্তি তীব্র আসক্তির বশে বিষয়ভোগে প্রমত্ত থাকে, তাহারা স্ব স্ব কর্মফলের দ্বারা চালিত হইয়া কখনও বা পশু, তির্যক প্রভৃতি জীবযোনিতে জন্মগ্রহণ করে; আবার কখন স্বর্গাদি লোকের সুখভোগ করে। (এইভাবে তাহারা জন্মমৃত্যুরূপ সংসার দুঃখ ভোগ করিতে থাকে)।।

কুরঙ্গ, মাতঙ্গ, পতঙ্গ, মীন ও ভৃঙ্গ—এই পাঁচ প্রাণী, শব্দ-স্পর্শ-রূপ-রস-গন্ধ এই পাঁচগুণের মধ্যে নিজ নিজ বিশেষ প্রিয় কোন একগুণে আসক্ত হইয়া মৃত্যুমুখে পতিত হয়। পাঁচগুণেরই বশীভূত মানুষের তাহা হইলে কী দুর্দশাই বা হইতে পারে?

রূপ-রসাদি-বিষয়সমূহ রাগদ্বেষাদি উৎপন্ন করার দোষে কৃষ্ণসর্পের বিষ হইতেও মারাত্মক। বিষ ভক্ষণকারীরই মাত্র মৃত্যুর কারণ হয়। কিন্তু চক্ষু দ্বারা দৃষ্ট (বা অন্য ইন্দ্রিয়দ্বারা গৃহীত) বিষয় মানুষের মৃত্যুর কারণ হইয়া থাকে।
সুদুস্ত্যজ বিষয়ভোগের আশারূপ দারুণ বন্ধন হইতে যিনি মুক্ত হইয়াছেন, তিনিই মোক্ষলাভের অধিকারী হন। কিন্তু ষড়দর্শনজ্ঞ পণ্ডিত ব্যক্তি যদি বিষয়ভোগে আকৃষ্ট থাকেন তো তাঁহার (কেবল শাস্ত্রজ্ঞানের দ্বারা) মুক্তির কোন আশা নাই।
সংসারসমুদ্রের পারে যাইতে উদ্যত, অল্পবৈরাগ্যসম্পন্ন মুক্তিকাম সাধকদিগকে ভোগাকাঙ্ক্ষারূপ কুম্ভীর গলায় ধরিয়া বেগে সাধনার পথ হইতে ফিরাইয়া মধ্যপথে ডুবাইয়া মারে।
যে দৃঢ়-বৈরাগ্যবান্‌ পুরুষ, তীব্র বৈরাগ্যরূপ তরবারির আঘাতে বিষয়রূপী কুম্ভীরকে বিনাশ করেন, তিনিই বিষয়ভোগেচ্ছা হইতে উৎপন্ন বাধাসমূহ অতিক্রম করিয়া মোক্ষলাভের অধিকারী হন।
যে নির্বোধ ব্যক্তি দুঃখদায়ক বিষয়সমূহের ভোগে লিপ্ত থাকে, মৃত্যু তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ ধাবিত হইতে থাকে। কিন্তু যে সাধক হিতকারী সদ্‌গুরুর উপদেশ গ্রহণ করিয়া নিজের বিচারসহায়ে অগ্রসর হয়, তাহার এই জীবনেই সাফল্যলাভ অর্থাৎ জীবন্মুক্তিপ্রাপ্তি ঘটিয়া থাকে। ইহা সত্য বলিয়া বিশ্বাস কর।
যদি তোমার মুক্তিলাভের আকাঙ্ক্ষা থাকে, তাহা হইলে বিষয়সমূহকে বিষের ন্যায় দূরে পরিহার কর। আর আদরের সহিত অমৃততুল্য উপকারী ভাবিয়া সন্তোষ, দয়া, ক্ষমা, সরলতা, শম ও দম— এই সকল সদ্‌গু঩ণের সর্বদা অনুশীলন কর।
অনাদি-অবিদ্যা হইতে উৎপন্ন ‘দেহাদিতে আমি-আমার-বোধরূপ’ যে অজ্ঞানবন্ধন, তাহা হইতে মুক্তিলাভের জন্য সাধনা প্রতিক্ষণে অবশ্য করণীয়। কিন্তু তাহা না করিয়া যে ব্যক্তি—এই-যে দেহ যাহাতে পরের অধিকার (অর্থাৎ মরণের পর যাহা কুকুর-শৃগালের ভক্ষ্য)—সেই দেহের পালনপোষণে আসক্ত থাকে, সেই ব্যক্তি দেহপোষণের দ্বারা আত্মস্বরূপ বিস্মৃত থাকে (ফলে আত্মঘাতীর সমান হীনদশা প্রাপ্ত হয়)।
শরীরের পালন-পোষণে ব্যাপৃত থাকিয়া যে ব্যক্তি স্ব-স্বরূপ উপলব্ধি করার কামনা করে, সে কাষ্ঠবুদ্ধিতে কুমীরকে ধরিয়া নদী পার হইতে ইচ্ছা করে।
দেহ-ইন্দ্রিয় প্রভৃতিকে ‘আমি-আমার’ জ্ঞান করিয়া সে-সকলের তৃপ্তিসাধনে ব্যাপৃত থাকা মুমুক্ষু ব্যক্তির পক্ষে মরণের সমান। (কেননা, এইরূপ আসক্তির ফলে জন্মমৃত্যু-প্রবাহ চলিতেই থাকে।) যিনি মোহকে জয় করিয়াছেন—দেহাদিতে আসক্তি সর্বতোভাবে ত্যাগ করিতে পারিয়াছেন—তিনি মুক্তিলাভের অধিকারী হন।
নিজের দেহে এবং স্ত্রী-পুত্র-গৃহাদিতে আসক্তিরূপ মৃত্যুর কারণকে ত্যাগ কর। এই মোহকে জয় করিয়া মুনিগণ সর্বব্যাপী পরমাত্মার স্বরূপ প্রাপ্ত হন।


ভক্ত-ভগবান


অন্ধকার হলো সত্যিকারের নিরাকার ব্রহ্ম। আর অন্ধকার থেকে যে আলো সৃষ্টি হলো উনি ভক্ত-ভগবান রূপে সকলের মাঝে লীলা করছেন। স্ব-প্রকাশ জ্যোতি হলেন ব্রহ্ম, যাঁর মধ্যে সকল রূপগুণ প্রকাশমান। জ্ঞান ছাড়া কিছুই প্রকাশ হতে পারে না। এই জ্ঞানই হলো সকল রূপের প্রকাশক। তিনি কেমন এবং তাঁর কর্ম কি—এই জ্যোতিই তাঁর একমাত্র প্রকাশক। এই জ্ঞানই হলো পুরুষ-প্রকৃতি, যার দ্বারায় তুমি-আমি ভাব বিদ্যমান।
এক ভক্ত জ্যোতির ধ্যান করতো। আত্মবিম্ব জ্যোতিকে জানবার জন্য সে খুবই ব্যাকুল হয়ে পড়লো। গুরুদেব তার অবস্থা বুঝতে পেরে তার নিকট উপস্থিত হলেন। ভক্ত সেবাধর্ম ত্যাগ দিবারাত্র জ্যোতির ধ্যানে মগ্ন। গুরুদেব তার ধ্যান ভঙ্গ করার জন্য তাকে ডাকলেন। কিন্তু ভক্তের ধ্যান ভঙ্গ হলো না। তাই গুরুদেব ফিরে গেলেন। তিনি আশ্রমে এসে আসনে বসে ভক্তের মঙ্গল কামনা করতে লাগলেন। ওদিকে ভক্তের ধ্যান যখন গাঢ় হলো তখন ওই আত্মবিম্ব জ্যোতি থেকে রাজরাজেশ্বরী রূপে জ্যোতির্ময়ী মাতৃরূপ তার সম্মুখে উপস্থিত হলেন। মা ওই ভক্তকে বললেন, তুমি যাঁকে অন্বেষণ করছো ওই জ্যোতি আমিই। মায়ের বাণী শ্রবণ করবার পরই ভক্তের ধ্যান ভঙ্গ হলো এবং আনন্দে তার হৃদয় ভরে উঠলো। ভক্ত (শিষ্য) তখন গুরুর অন্বেষণে বের হলো। গুরুর সাক্ষাৎ পেয়ে তার উপলব্ধির কথা বলতে গিয়ে আবার তার সমাধি হলো। কিছুক্ষণ পর তার সমাধি ভঙ্গ হলে বাহ্যিক জ্ঞান ফিরে এলো। গুরুদেব শিষ্যকে বললেন—যা ব্যাটা, তোর জনম ধন্য। তোকে আর এ সংসারে আসতে হবে না। তোর মনের নির্বাণ হয়েছে। শিষ্য গুরুর কথা শুনে কিছুই বুঝতে পারলো না। সে গুরুদেবকে জিজ্ঞেস করলো—“গুরুদেব নির্বাণ কার হলো এবং সে কে? আমি এসব কিছুই বুঝতে পারছি না। আমি এমন কি অন্যায় করলাম যে আমি আর আপনার কাছে স্থান পাব না?” শিষ্যের কথা শুনে গুরুদেব বললেন -

“ওরে ব্যাটা, তুই তো খুব চালাক, তুই গুরুকে জানতে চাস। তবে শোন, তুই যা পেয়েছিস সে সবই অর্পণ করতে হবে, তারপর গুরুর কৃপায় সব জানতে পারবি। তবে একটা কথা জেনে রাখ্‌, গুরুকে জানতে পারলে আর কিছু জানার বাকি থাকবে না।” তারপর শিষ্য গুরুদেবকে জিজ্ঞেস করলো—“গুরুদেব, আমাকে দয়া করে বলুন, আমি কি গুরুকে উপলব্ধি করতে পারবো?” তখন গুরুদেব বললেন—“গুরুকে জানা খুবই কঠিন। কারণ গুরু হলেন মূল, আর মূলকে জানা অনেকেরই ভাগ্যে হয় না। গুরুকে জানতে হলে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর এবং ব্রহ্ম-আত্মা-ভগবান সকলকেই জানতে হবে। তুই এক কাজ কর, তুই আজ থেকে ভগবানের সাধনায় রত হ। তা হলে ভগবানের কৃপায় ধীরে ধীরে গুরুর মহিমা সবই উপলব্ধি করতে পারবি। তোর মন যদি গুরুমুখী হয় তবে তোর আর কিছুই জানতে বাকি থাকবে না।” তাই বলি—ভক্তের ভাব এমনই হওয়া উচিত, যার ফলে ভগবান ছাড়া তার আর কোন কিছুতেই জানার প্রবৃত্তি না থাকে। এর ফলে ভগবানও ওই ভক্ত ছাড়া থাকতে পারবেন না। যেমন—বৃন্দাবনে যে সব ভক্ত ছিল, তারা কেউই কৃষ্ণ ছাড়া থাকতে পারতো না। তারফলে বৃন্দাবনে ওই সময় ভাবের জোয়ার বয়ে গিয়েছিল। ওই বৃন্দাবনের ভক্তগণের জন্য ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নয়ন জলে শ্যামকুণ্ডের সৃষ্টি হয়েছিল। এদিকে শ্রীকৃষ্ণের জন্য শ্রীমতি রাধার নয়ন জলে রাধাকুণ্ডের সৃষ্টি হয়েছিল। হয়তো তোমরা বলবে যে রাধা ছাড়া বৃন্দাবনে কি আর কোন ভক্ত ছিল না! রাধার মতো অনেকেই ছিল, কিন্তু কেউই আর বৃন্দাবনের রাধা হতে পারেনি। তাই রাধাকে নিয়ে সখীগণের বৃন্দাবন লীলা। বৃন্দাবনে যে লীলা হয়েছিল তা শুধু বৃন্দাবনের ভক্তদের জন্যই হয়নি, তা সমস্ত মানুষের শিক্ষার জন্যই হয়েছে। কিন্তু মানুষ ওই লীলাকে ভুল বুঝেছে। যেমন—ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে যে যোগ শিক্ষা দিয়েছিলেন তা সকল মানুষকে লক্ষ্য করেই। মানুষ কিন্তু উলটো বুঝে কর্ম শুরু করে দিল। তারা গীতা পাঠ করে ভগবানের কর্ম শেষ করতে বসলো। আজকাল সকলেই বলে যে গীতা একটি বড় গ্রন্থ, কিন্তু গীতা পাঠ করে কতজন বড় হয়েছে বা কতজন ত্যাগী এবং জ্ঞানী হয়েছে? আসল কথা গীতা একটি পবিত্র গ্রন্থ। একে না বুঝে শুধু মুখস্থ করলে কি হবে? অর্জুন বলতে সকল মানুষকেই বোঝায়। কিন্তু অনেকের ধারণা, অর্জুন একটি মানুষের নাম। এই ধারণা নিয়ে মানুষ গীতাকে গল্প গ্রন্থ ভেবে মুখস্থ করে বসে আছে।


আত্মকেন্দ্রিক


তজো অভিমানা সীখো জ্ঞানা
সত্‌ গুরু সঙ্গত তরতা হৈ।
কহৈঁ কবীর, কোই বিরল হংস
জীবত হী জো মরতা হৈ।।


(অভিমান ত্যাগ করিয়া জ্ঞান শিক্ষা কর। সদ্‌গুরুর সঙ্গ লইলেই ত্রাণ। কবীর বলেন—জীবনেই মৃত্যুকে বরণ করিয়াছেন, সেইরকম হংসসাধক বিরল।)
জীবনে কৃতিময় অহং বিলুপ্তিই বিজ্ঞানী মৃত্যু। অনন্ত জন্ম-মৃত্যুর শৃঙ্খল হইতে নিজেকে মুক্ত করিতে প্রথমেই প্রয়োজন বিজ্ঞানী মৃত্যুর। দেহত্যাগ তো আর মৃত্যু নয়, উহা দেহান্তর মাত্র। গীতার কথায়—‘‘বাসাংসি জীর্ণানি যথা বিহায় নবানি গৃহ্নাতি।’’ বিজ্ঞানী আচার্য্যকুল তাঁহার সন্তানদের শিক্ষা দেন বিজ্ঞানী মৃত্যু। গীতায় শ্রীকৃষ্ণ ‘‘মন্মনাভব মদ্ভক্ত’’, ‘‘সর্ব্বধর্ম্মান্‌ পরিত্যজ্য’’ ‘‘ময্যর্পিত মনোবুদ্ধিঃ’’ ইত্যাদি বাক্যদ্বারা এবং বিশ্বরূপাদির অনুভূতির দ্বারা অর্জ্জুনকে শিক্ষা দিয়াছেন বিজ্ঞানী মৃত্যুর ধারা।
আত্মসংজ্ঞাপি—নির্যানশক্তিসম্প,এই আচার্য্যকুল সামগ্রিক জীবনে নিজের সাধনাকে রূপায়িত করিয়া নিজেরাই হন পরিতৃপ্ত। ইঁহারাই সন্তানদের মধ্যে দেখেন নিজেরই ব্যষ্টিরূপ আর নিজের মধ্যে দেখেন সন্তানদের সমষ্টি রূপ। ইঁহাদেরই সেবক ভার। ইঁহারাই সন্তানদের (শিষ্যদের) শিক্ষা দেন যথাযথ ভগবদ্পূজা। ইঁহারাই পরম গোপনীয় আধ্যাত্মিক তত্ত্ব ও কর্ম্মধারা অকপটে সন্তানদের(শিষ্যদের) নিকট প্রকাশ করেন। গীতায়ও অর্জ্জুনকে শ্রীকৃষ্ণ এই কথাই বলিয়াছেন—

সর্ব্বগুহ্যতমং ভূয়ঃ শৃণু মে পরমং বচঃ।
ইষ্টোহসি মে দৃঢ়মিতি ততো বক্ষ্যামি তে হিতম্‌।।

(সর্ব্বপ্রকার গোপন হইতেও গোপনীয় আমার পরম বাক্য (পরমপুরুষার্থ সাধনবাণী) পুনরায় শ্রবণ কর। তুমি আমার একান্ত প্রিয়, এজন্য তোমাকে হিতবাক্য বলিব।)
আত্মকেন্দ্রিক—ইঁহাদেরই জগতে সেব্য হইয়া বাঁচিয়া থাকিবার ভাব। ইঁহারাই প্রচার করেন ‘‘গুরু (আচার্য্য) ভগবান’’, ‘‘নাদ্বৈত গুরুনা সহ’’ (আচার্য্যের সহিত অদ্বৈত বোধ রাখিবে না) ইত্যাদি। এবং সন্তানদের পূজার আসনে দেন নিজের প্রতিকৃতি এবং ধ্যানের জন্যও দেন নিজের প্রতিকৃতি কল্পনারই নির্দেশ। ইঁহাদের জীবনেই দেখা যায় অকপট আচরণের অভাব। প্রায়ই স্বীয় অধ্যাত্মকর্ম্মের আচরণ ও সন্তানদের প্রতি আত্মিক কর্ম্মোপদেশ এ দুইটির মধ্যে কোন সঙ্গতি থাকে না। যে সহজ কর্ম্মরূপী অজপা ও নাদসাধনায় আচার্য্য নিজকে নিয়ত শুদ্ধ রাজযোগে প্রতিষ্ঠিত করিয়া রাখিতেছেন, উহার বিন্দুমাত্র জ্ঞানও স্বেচ্ছায় তাঁহাদের মুক্তিকামী সন্তানদের দান করিতে যেন তাঁহারা কুণ্ঠাবোধ করেন। নিজের পদগৌরবের লোভই এই আত্মকেন্দ্রিকতার কারণ। অধ্যাত্মজ্ঞানহীন সাধারণ জীবন এ সকল আচার্য্যদের অবচেতন মনের সূক্ষ্ম কৃতিময় অহংজাত চতুর আচরণকে সম্যক্‌ বু঩ঝিতে পারে না। অনেক সময় তাহারা নিজেরাও উহা উপলব্ধি করিতে না পারিয়া নিজে যেমন ভ্রান্ত পথ অবলম্বন করে, তেমন অন্যকেও সেইভাবে পরিচালিত করে। ইহাদের লক্ষ্য করিয়াই কবীর দুঃখ করিয়া বলিয়াছেন—

‘‘কোই বিরল হংস— জীবত হী জো মরতা হৈ’’।

আত্মবিলম্ভাজ্ঞ—এই শ্রেণীর আচার্য্যেরাও সহজ মানুষ। স্বীয় সাধনাকে সামগ্রীক জীবনে রূপায়িত করিতে তাঁহাদেরও একটা আন্তরিক প্রচেষ্টা রহিয়াছে।


 আত্মা-অনাত্মা


 যথার্থ জ্ঞানের দ্বারা জীবের অবিদ্যারূপ উপাধির বিনাশ হয়, অন্য কোন উপায়ে ইহার নাশ হয় না। ব্রহ্মের সহিত আত্মার একাত্বানুভবই জ্ঞান, শ্রুতি ইহা বলেন।
আত্মা কি, অনাত্মাই বা কি, এই বিচার যথাযথ ভাবে করিতে পারিলে আত্মজ্ঞানের উৎপত্তি হয়। অতএব জীব ও ব্রহ্মের স্বরূপ বিচারের দ্বারা নির্ণয় করা কর্তব্য।
অত্যন্ত কর্দমাক্ত জল যেমন (ফটকিরি প্রভৃতির সংযোগে) কাদা থিতাইয়া যাওয়ার পর স্বচ্ছ ও নির্মল হইয়া যায়, অবিদ্যা-দোষ দূরীভূত হইলে আত্মাও সেইরূপ স্ব-মহিমায় প্রকাশ পায়।
মিথ্যাজ্ঞানের নিবৃত্তি হইলে জীবের অন্তরতম আত্মাই যে নিত্যশুদ্ধ ব্রহ্ম, ইহা প্রত্যক্ষরূপে অনুভূত হয়। এই কারণে সম্যগ্‌রূপে বিচারের দ্বারা আত্মাতে আরোপিত অন্তঃকরণাদি-অনিত্যবস্তুসমূহের নিরাস করা অবশ্য কর্তব্য।
পূর্বে যেসকল যুক্তি দেওয়া হইয়াছে সেইসকল-অনুসারে বিজ্ঞানময়কোশ চিদাত্মা হইতে পারে না। এই বিজ্ঞান ময়-কোশ বিকারশীল (কাম, সংকল্প প্রভৃতি বিকার ইহাতে উৎপন্ন হয়)। ইহা জড়, দেশকালের দ্বারা সীমাবদ্ধ, দৃশ্যবস্তু এবং ব্যভিচারী (সর্বকালে একরূপ থাকে না—যেমন সুষুপ্তিকালে ইহা প্রকাশ পায় না)। এই প্রকার অনিত্য বস্তু কখনও নিত্য আত্মার সহিত অভিন্ন হইতে পারে না।
বাঞ্ছিত বস্তুর লাভে প্রকাশপ্রাপ্ত, প্রিয়-মোদ-প্রমোদরূপে পরিণত, স্থিরীভূত এবং অন্তর্মুখ-তমোবৃত্তি আনন্দ-স্বরূপ আত্মার দ্বারা প্রতিবিম্বিত হইয়া আনন্দময়-কোশরূপে পরিণত হয়। সৌভাগ্যশালী ব্যক্তিগণের পুণ্যকর্মের অনুভবের সময় এই আনন্দময় কোশ স্বতঃ প্রকাশ পায়। দেহধারী জীব-মাত্র বিনা চেষ্টায় এই আনন্দময়-কোশে সুখানুভব করে।
সুষুপ্তিকালে আনন্দময়-কোশের বিশেষ প্রকাশ হয়। স্বপ্নদর্শনের সময় বা জাগ্রৎকালে বাঞ্ছিত বস্তুসমূহের দর্শন-শ্রবণাদির ফলে ইহার অল্প প্রকাশ দেখা যায়।
তমোগুণরূপ উপাধিযুক্ত বলিয়া, প্রকৃতির পরিণাম বলিয়া, পূর্বকৃত পুণ্যকর্মসমূহের ফলে উৎপন্ন বলিয়া এবং অন্নময়াদি বিকারসমূহের মধ্যে বর্তমান বলিয়া এই আনন্দময় কোশও পরমাত্মা হইতে পারে না।
যুক্তির দ্বারা এবং শ্রুতিপ্রমাণের সহায়ে অন্নময়াদি পাঁচটি কোশ আত্মা নয় ইহা প্রমাণিত হইলে মিথ্যা বলিয়া প্রমাণিত এই কোশসমূহ যাঁহার আশ্রয়ে প্রকাশিত হয়, সেই স্বয়ংপ্রকাশ চৈতন্যস্বরূপ আত্মা অবশিষ্ট থাকেন।
পঞ্চকোশ হইতে ভিন্ন স্বপ্রকাশ এই যে আত্মা, তিনিই অবস্থাত্রয়ের সাক্ষী, তিনি নির্বিকার, নিরঞ্জন এবং আনন্দস্বরূপ। বিদ্বান্‌ ব্য঩ক্তি (শ্রুতি, যুক্তি ও অনুভবসহায়ে) এই শুদ্ধ আত্মাকে স্বীয় আত্মার সহিত অভিন্ন বলিয়া জানিবেন।
শিষ্য বলিলেন—হে গুরো, পাঁচটি কোশই মিথ্যা বলিয়া প্রমাণিত এবং সেইগুলি আত্মা নয় বলিয়া স্থিরীকৃত হওয়ার ফলে, নিজের মধ্যে এবং স্থূল ও সূক্ষ্ম জগতের মধ্যে সবকিছুর অভাব ব্যতীত অন্য কিছু দেখিতে পাই না। অতএব আত্মবিচারশীল ব্যক্তির পক্ষে নিজের আত্মস্বরূপে সত্যবস্তুরূপে জ্ঞেয় কোন বস্তু আছে কিংবা নাই?


প্রার্থনা কেন করি 


মানুষের জীবন নিত্য অভাব ও অভিযোগ ও প্রয়োজনে পরিপূর্ণ, সুতরাং তার কামনা থাকেই, কেবল দেহে প্রাণে নয়, কিন্তু মনে এবং আধ্যাত্মিক সত্তাতেও। যখন সে জানে যে জগৎ চলছে কোন উচ্চশক্তির নিয়ন্ত্রণে, তখন সে ঐ উচ্চশক্তির কাছে তার অভাব পূরণের জন্য প্রার্থনা জানায়, যাতে তার জীবনের বন্ধুর পথে ও কঠিন সংগ্রামে ভগবৎ সাহায্য ও আশ্রয় লাভ করতে পারে। ধর্মীয় রীতিতে ভগবানের কাছে যতই কেন স্থূলভাবে প্রার্থনা করা হোক, যতই কেন স্তবস্তুতির দ্বারা ও নৈবেদ্যাদি উৎসর্গ
প্রভৃতি ঘুষ দেওয়ার দ্বারা ভগবানের তুষ্টি সাধনের চেষ্টা করা হোক, যার মধ্যে আধ্যাত্মিক আস্পৃহা প্রায়ই কিছুই থাকে না, তথাপি এ কথা সর্ববাদীসম্মত সত্য যে ভগবৎ প্রার্থনার প্রয়োজন আছে আমাদের সত্তার পক্ষে। প্রার্থনার যে কোন সুফল আছে এতে প্রায়ই সন্দেহ প্রকাশ করা হয়, বলা হয় যে তা অনাবশ্যক এবং নিষ্ফল।
এ কথা সত্য যে বিশ্বনিয়ম তার আপন লক্ষ্যের পথে চলবে, কারো ব্যক্তিগত উপরোধে টলবে না, আর এ কথাও সত্য যে যিনি পরাৎপর তিনি তাঁর সর্বজ্ঞ শক্তিতে দেখতে পান যে কখন কি করা দরকার, তিনি মানুষের চিন্তা ও ব্যক্তিগত কামনার দ্বারা জগৎ নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে কোনরূপে প্রভাবিত হতে পারেন না। কিন্তু তথাপি সেটা যান্ত্রিক নিয়ম নয়, সেটা জীবন্ত শক্তির ক্রিয়া এবং সেখানে মানুষের আস্পৃহা ও শ্রদ্ধাবিশ্বাসের স্থান নিতান্ত অনর্থক নয়।
প্রার্থনা মানুষের সেই আস্পৃহা ও শ্রদ্ধাবিশ্বাসকেই একটা আকার দেয়। যদিও তা অনেক সময় নিতান্ত স্থূল ও ছেলেমানুষি হয়ে দাঁড়ায়, তথাপি তার মধ্যে একটা তাৎপর্য থাকে এবং কিছু প্রকৃত শক্তিও থাকে। অর্থাৎ তা মানুষের ইচ্ছা ও আস্পৃহা ও শ্রদ্ধাকে ভগবানের চেতন ইচ্ছার সংস্পর্শে এনে একটা সচেতন ও জীবন্ত সম্বন্ধ স্থাপন করে।
প্রথমে যদিও সেই সম্বন্ধ অহংবুদ্ধি প্রণোদিত হওয়াতে নিতান্ত নিম্নস্তরের হয়, কিন্তু তার পরে আমরা তার উচ্চতর আধ্যাত্মিক সত্যে গিয়ে পৌঁছাতে পারি। তখন আর কি চাইছি তা নিয়ে কথা নয়, মানুষের জীবনের সঙ্গে ভগবানের চেতন সংস্পর্শ ও লেনদেন নিয়ে কথা। আধ্যাত্মিকের দিক থেকে এই চেতন সংস্পর্শের শক্তিমূল্য অনেক বেশি। জীবনে আমরা একান্ত আত্মনির্ভর হয়ে যে সংগ্রাম করি, প্রার্থনা তার মধ্যে একটা পূর্ণতর আধ্যাত্মিক অনুভূতি এনে আমাদের শক্তিসমৃদ্ধ করে। শেষ পর্যন্ত সেই প্রার্থনা তার চেয়ে বৃহত্তর সম্বন্ধে গিয়ে বিলীন হয়, অর্থাৎ তার ভিতরকার আস্পৃহা ও শ্রদ্ধাবিশ্বাসই আনন্দের বস্তু হয়ে বড় হয়ে ওঠে। তার অর্থ তখন আরো উচ্চস্তরে গিয়ে উদ্দেশ্যবিহীন ভক্তিতে উপনীত হয়, কোন দাবিদাওয়া ঘুচে গিয়ে তখন তা সহজ ও বিশুদ্ধ ভগবৎ প্রেমে পরিণতি লাভ করে।
মানুষের আত্মা ভগবানের কাছে চায় সাহায্য, চায় আশ্রয় এবং নির্দেশ, চায় সাফল্য—অথবা চায় জ্ঞান, চায় শিক্ষণ, চায় আলো, —কারণ তিনি জ্ঞানসূর্য, —অথবা সে চায় যন্ত্রণা থেকে মুক্তি, ব্যক্তিগত ব্যথাবেদনা অথবা জগৎযন্ত্রণা থেকে মুক্তি, অথবা তার ভিতরকার হেতু থেকে মুক্তি।

ব্যাধি


 ব্যাধির আক্রমণে নত হইয়া পড়িও না, ব্যাধি দেহধারী-মাত্রেরই হয়। যে উন্নত লক্ষ্য তোমার জীবনের পথগতি নিয়মিত করিতেছে, সেই লক্ষ্যে পৌঁছিতে হইলে দেহের ধর্ম্মকে অস্বীকার করিয়া আত্মার শক্তিতে শক্তিমান্‌ হইতে হইবে। তোমার দ্বারা যে শতকোটি ব্যাধিতের আরোগ্যের দিগ্‌দর্শন হইবে, তাহা নির্দ্ধারিত-রূপে জানিয়া নিজের এই রোগ-যন্ত্রণাকে অগ্রাহ্য কর। রোগ-শোক চিরস্থায়ী নহে, অমৃতের পুত্রের পক্ষে অমৃতই চিরস্থায়ী। শাশ্বত জীবন যার জাগ্রত হইয়াছে, বিনশ্বর দেহ বিচলিত বা পরিভ্রষ্ট হইলেও সে কখনও হতাশ বা কর্ত্তব্য-পথচ্যুত হয় না। তোমাকে অচঞ্চল প্রযত্নে আত্মস্থ থাকিতে হইবে, দুঃখ-দহন, ব্যাধি-বেদন সব একেবারে অগ্রাহ্য করিয়া চলিতে হইবে। হে বীর, জগতের শত জন যখন শত দিক হইতে তোমাকে ডাকিতেছে, তোমার সবল হস্তের সহায়তা চাহিতেছে, আতুর-আগ্রহে তোমার বাহু-যুগলের নির্ভর মাগিতেছে, সে সময়ে দেহ জীর্ণ ও রোগশীর্ণ বলিয়া কোন লাজে তুমি ম্রিয়মান, রহিতে পার? দেহ শয্যাশায়ী হইলেই যে তোমার চিত্তও ধূলিধূসরিত হইবে, এ কেমন কথা? দেহের প্রার্থনাকে অগ্রাহ্য করিয়া আত্মার আহ্বানে সাড়া দাও, রোগের কাতরতা ভুলিয়া জগতের দুঃখে সহানুভূতিতে আজ তরল হইয়া গলিয়া যাও। তোমার আদর্শ তোমাকে যেমনটী চাহিতেছে, তোমার আপনার জনেরা তোমাকে যেমনটী দেখিলে কৃতার্থ হইবেন, তুমি আজ তেমনটী হও বাছা।
বলিবার কথা আমার অনেক আছে। এত আছে যে, কণ্ঠ বাহিয়া বাহিরিবার জন্য তাহারা বিষম ঠেলাঠেলি লাগাইয়া দিয়াছে। তাহাতে আমার বুকের মধ্যে অসহনীয় উত্তাপ ও বেদনার সৃষ্টি হইয়াছে। কারণ, আমার যে শুধু একটা বই দুইটী কণ্ঠ নাই! সব কথা বলিবার জন্য যে শত শত কণ্ঠ চাই,—যে কণ্ঠে বজ্র ও বীণা একত্রে গর্জন-ঝঙ্কারে মুখরিত হইয়া উঠে, তেমন সহস্র কণ্ঠ চাই। আজ তোমাকে কোন্‌ কথা আমি বলিব? চারিদিকে খোলা চোখে চাহিয়া দেখ, খোলা কাণ পাতিয়া শুন, সকলে আজ কি বলিতে চাহিতেছে। আজ খোলা চোখে চাহিতে পারিলে আমার মুখের কথা না শুনিয়াও তুমি আমার মরমের কথা বুঝিতে পারিতে। ঐ যে বিশীর্ণ-কঙ্কাল আমারই শতকোটি ভাই-বোন, ঐ যে ক্ষুৎ-পিপাসা-পীড়িত আমারই লক্ষ কোটি আপনার জন, উহাদের মুখপানে তাকাইয়া দেখ, বুঝিবার মত দরদ থাকিলে অনায়াসে আমার কথা বুঝিবে। দিবা-অবসানে অন্ধকার যেমন স্বতঃসিদ্ধ, উহাদের মুখেও বেদনার আর্ত্তি, পীড়নের হতাশা তেমনই সুব্যক্ত। উহাদের দেখিয়া যদি তুমি উহাদের কথা বুঝিতে পার, যদি প্রাণের সমগ্রটুকু দিয়া উহাকে ধারণ করিতে পার, তবে আমি চুপ করিয়া বসিয়া থাকিলেও আমার কথা বুঝিবে। নতুবা রয়টারের তারে তারে পৃথিবী ঢাকিয়া ফেলিলেও উহা তোমার নিকট অবোধ্যই রহিবে। দীনদুঃখীর মর্ম্মবেদনা যদি আমার কথায় তোমার হৃদয়ে জাগিয়ে উঠে, অত্যাচারিতের আর্ত্তধ্বনি যদি আমার কণ্ঠে পরিস্ফুট হইয়া তোমার শ্রবণে ধ্বনিয়া উঠে, তবেই উহা প্রকৃত আমার কথা হইবে।
তুমি তোমার কাছেও আমার কথা জিজ্ঞাসা করিও। আয়নায় মুখ দেখিয়া মুখের উপরে আমার কথা পাঠ করিও। যদি আমার কথা শুনিতে চাও, তবে তোমার কথা শুনিতে চাহিও। আজ তোমরা আত্মস্থ হও, আজ তোমরা নিজের পানে তাকাও আর পরের পানে ফিরিয়া চাও, পরের দুঃখ দূর করিতে বিপদ-সাগরে ঝাঁপাইয়া পড়। তোমাদের কর্ম্ম, তোমাদের জ্বলন্ত আত্মত্যাগ যেদিন মুখর হইয়া উঠিতে শিখিবে, সেদিন আর আমি আমার শতকণ্ঠ নাই বলিয়া দুঃখ করিব না। শুধু মন দিয়া চাহিলে চলিবে না, প্রাণ দিয়া চাওয়া চাই। প্রাণ দিয়া চাহিলেই চাইবার মত চাওয়া হয়, সুতরাং পাইবার মত পাওয়াও হয়। মন দিয়া চাহিয়া ক্ষণভঙ্গুর স্মৃতিশেষ কল্যাণকে পাইতে পার, স্মৃতির সম্ভাব্যতা-বিহীন নিত্যপ্রত্যক্ষ অচলপ্রকাশ পরমানন্দকে লাভ করিতে পার না। তাই তোমাকে প্রাণ দিয়া চাহিতে হইবে। প্রাণ দিয়া চাহিতে পারিলে বিশ্বজগৎ তোমার সাথে ঐকতান-বদ্ধ হইয়া পরম প্রার্থনীয়কে তোমার জন্য চাহিবে।
যখন তুমি প্রাণ দিয়া চাহিবে, বিশ্বপ্রাণ তখন টলিবে। নিজেকে যতই কেন পৃথক করিয়া আজ ভাব না লক্ষ্মী, জগতের একটা তুচ্ছাতিতুচ্ছ অণুপরমাণুকেও ছাড়া তুমি নও, তোমাকে ছাড়াও উহাদের কাহারও অস্তিত্ব নাই। আর, প্রাণ অনংশ, অখন্ড ও অব্যর্থ। তাই প্রাণের সাধনা কখনও যুক্তিতর্কে খন্ডিত হইতে পারে না, ব্যাখ্যায় ব্যর্থ হয় না।


 মৃত্যু


মৃত্যুকে মানুষ ভয় করে কেন? মৃত্যুর পরে কি অবস্থা হবে, সে তা জানে না। জীবনে যে নিশ্চিত নিরাপত্তা গড়ে উঠেছে, তাকে ছেড়ে সে মৃত্যু-পরবর্তী অনিশ্চিত অবস্থায় যেতে3333333 রাজি নয়। আস্তিকেরা যখন মরতে ভয় পায় তখন তার মধ্যে একটা যুক্তি থাকতে পারে—মৃত্যুর পর স্বর্গে না নরকে যাবে, এই ভেবে আস্তিকেরা ভয় পেতে পারে। কিন্তু নাস্তিকেরা কেন মর্‌তে ভয় পায়? তারা তো বলে যে, মৃত্যুর পর কিছু থাকে না। আস্তিক-নাস্তিক সবাই মৃত্যুকে ভয় পায় কেন? শারীরিক কষ্টের জন্যে? তা তো সব সময় নয়! আসলে মানুষ তার জীবনে নিরাপত্তার খোঁজে অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করে—তার স্ত্রী-সন্তান-আত্মীয়-বন্ধু-বাড়ী-ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ইত্যাদির অজস্র মানুষ ও বিষয়ের ওপর সে নির্ভর (depend) করছে। দীর্ঘকাল ধরে এই নির্ভরতা অভ্যাস করার ফলে তার জীবনে এক বিশেষ রকম ছন্দ (rythm) এসেছে। মৃত্যু এসে তার এই ছন্দ নষ্ট করে দেবে, এটি ভেবেই মানুষ ভয় পায়। মানুষের সবচেয়ে বড় ত্রুটি তার মানসিক নির্ভরতা (psychological dependence) এবং এই নির্ভরতারই অন্য নাম আসক্তি (attachment)। সে আসক্ত তার স্ত্রী-সন্তানে, বাড়ী গাড়ি-সম্পত্তিতে, বন্ধু-বান্ধব-আত্মীয়-স্বজনে। সে এতদিন যাদের ওপর নির্ভর করছিল, যে বিষয়ে আসক্ত ছিল, মৃত্যু সেগুলিকে কেড়ে নেবে। জীবনের ছন্দ হারানোর এই যে অনিশ্চয়তা, এটি তার চেতন ও অবচেতন মনে কাজ করে। আর, এরই নাম ‘ভয়’।
মানুষ সবসময় নিরাপত্তা (security) খোঁজে এবং নিজের জীবনে সে এক ধরনের কাল্পনিক নিরাপত্তা গড়েও তোলে। ‘কাল্পনিক’ শব্দটি ব্যবহার করলাম, কারণ স্থায়ী নিরাপদ (permanently secured) বলে এ-জগতে কিছু নেই। চাকুরি যাবার ভয়, রাজভয় ইত্যাদিও এ-রকম। অপমান বা মানহানিকে মানুষ ভয় করে, কারণ সমাজে বা পরিবারে সে এতদিন যে সত্তা (image) বা স্থান (status) নিয়ে নিরাপত্তা গড়ে তুলেছিল, অপমানের ফলে সেই দুটি বিলীন হয়ে তাকে নতুন সত্তা ও স্থানে সরিয়ে দিতে পারে।
ভূতের ভয় মানুষ কেন পায়? কারণ, ভূতের মুখোমুখি হলে সে কোন্‌ পরিস্থিতিতে পড়বে, তা জানে না; এই নতুন পরিস্থিতিতে কিভাবে সে আত্মরক্ষা করবে, তাও তার জানা নেই। দেখা যাচ্ছে, সব রকম ভয়ের কারণই হলো নিরাপদ অবস্থা থেকে অনিশ্চিত অবস্থায় যাওয়ার আশংকা।
ভয় ব্যাপারটি যদিও বর্তমান কালে হয়, তবুও এর বিষয় ভবিষ্যৎ কালের। বর্তমানকে আমি জানি, ভবিষ্যতকে জানি না। কি বিপদ ঘটবে তা যদি আমার জানা থাকে, তবে তার জন্যে আমি প্রস্তুত হতে পারি। কিন্তু আমি জানি না, মৃত্যু হলে কি হবে, ভূত দেখলে কি হবে, চাকুরি গেলে কি হবে, পুলিশ ধরলে কি করবে। এই যে ‘না জানা’ এটিই আমার মনে ভয় সৃষ্টি করে।
যে-কোনো ভয়ের কারণ অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। মানুষ সব সময় নিরাপত্তা খুঁজছে, দৈহিক ও মানসিক দিক থেকে। তার চিন্তা এই নিরাপত্তা খোঁজায় অভ্যস্ত। এই নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবার উপক্রম হলেই সে ভয় পায়। আমি যদি মনে মনে বিচার করি—কেন আমি নিরাপত্তার জন্যে বিশেষ বিশেষ মানুষে ও বিষয়ে আসক্ত—তবে দেখবো যে আমি কতকগুলি কাল্পনিক ব্যাপারকে বাস্তব বলে ধরছি। এবং এটিই আমার জীবনে বড় বড় সমস্যা নিয়ে এসেছে।
তাত্ত্বিক দিক ভয়ের কারণ বুঝলেও যেটি প্রয়োজন তা হলো, আমি যখন ভয় পাচ্ছি তখন নিজে নিজে চিন্তা করা—কেন ভয় পাচ্ছি। এভাবে নিজের ভয়ের কারণ নিজেকেই আবিষ্কার করতে হয়, সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় নিজেকে। গান্ধীজী লিখছেন যে, ছোটবেলা ভূতের ভয় পেলে তিনি রাম-নাম করতেন। রাম-নাম করলে কি ভূতের ভয় যায়? আসলে ভয় ব্যাপারটি হলো মনের এক বিশেষ অনুভূতি।


একাগ্রতার শক্তি


একাগ্রতাই—যুদ্ধ এবং ব্যবসা বাণিজ্য; সংক্ষেপে মানুষের যে কোন ব্যবহারিক কাজে—সকল শক্তির মূল রহস্য।
সুনির্দিষ্ট চিন্তা করার ক্ষমতা তোমার নিজস্ব, তাকে দর্শন করা, আয়ত্তে আনা ও ঈশ্বরের মুখোমুখি হওয়ার ক্ষমতাও তোমার নিজের ‘হাতে’।
যিনি দৈনন্দিন জীবনে একাগ্র মনোনিবেশ, দুর্দম ইচ্ছাশক্তি ও অপ্রয়োজনীয় বিষয় সকল স্বেচ্ছায় ত্যাগ করার অভ্যাসে রপ্ত হয়েছেন, তিনি চতুর্দিকে টলায়মান বিশৃঙ্খলার মধ্যে বিশাল স্তম্ভের মতো দাঁড়িয়ে থাকেন—যখন অপেক্ষাকৃত দুর্বল সহযোগীবৃন্দ প্রবল ঝড়ে খড় কুটোর মতো উড়ে যায়।
একাগ্রতা দ্বারা মানসিক স্থৈর্য লাভ হয়।
যে কেহ মনকে ব্রহ্মরূপে উপাসনা করেন, মনের গতি যতদূর, তিনিও ততদূর পর্যন্ত যথেচ্ছগতি হন।
একাগ্রতা দ্বারা শক্তিলাভ হয়। এই তত্ত্ব আমরা সকলেই কিছুটা মাত্র বুঝি, কিন্তু অধিকাংশই বুঝি কেবল বুদ্ধি দিয়ে। আজকাল অনেকেরই ধারণা কাম্য বস্তুসমূহের উপর মনঃসংযোগ করে তারা তা পেতে পারে। কিন্তু তা হল খুব নগন্য স্তরের মানসিক প্রক্রিয়া। তুচ্ছ বস্তুসকলে মন একাগ্র করে যা লাভ হয়ে থাকে তাকে প্রকৃত সাফল্য বলা যায় না। তাহলে তো অধিকাংশ মানুষই সকলকাম হতে পারত। চোরও পরস্বাপহরণ করে মন একাগ্র করে। কিন্তু চোরের এই প্রকার কার্যে আমাদের ঈর্ষার উদ্রেক হয় না। আপাতভাবে সে তার অভীষ্ট লাভ করে—এবং লোকের বাহবাও পেতে পারে কিন্তু এর ফলে তার চারিত্রিক কাঠামো দুর্বল হয়ে পড়ে।
ভুল নির্বাচন ও প্রতিক্রিয়া
মানুষ যা চায় তাই পেতে পারে। ক্রমে ক্রমে আমাদের অভীষ্ট সিদ্ধ হয় অতএব, সেজন্য আমাদের কামনা বাসনা পরিশুদ্ধ করা একান্ত আবশ্যক। আমরা যেন কোন অশুভ বস্তু আকাঙ্ক্ষা না করে বসি, কারণ, কামনা পূরণার্থে অসৎ বস্তু লাভের জন্য সচেষ্ট হলে তার প্রতিক্রিয়া হবেই। অধিকন্তু এরূপ কাম্য বিষয়সকল লাভের পর মনে হতে পারে, আমরা যেন সে সকল জিনিস আদৌ না চাই।
একাগ্রতার অর্থ আত্মসংযম
একাগ্রতার নির্গলিতার্থ—প্রভূত আত্মসংযম। যার নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ নাই, যে সহজেই বিচলিত, ক্রুদ্ধ বা প্রতিশোধ পরায়ণ হয়, তার মধ্যে যথার্থ সংযমের অভাব; যদিও সে সংযম দ্বারা লভ্য ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষা করে। কিন্তু তার দুর্বলতা হেতু সে তা পায় না। প্রকৃত একাগ্রতার অর্থ, শক্তি—শক্তি মনের এবং চরিত্রের—এবং তা ধ্বংসাত্মক উদ্দেশ্য সাধন বা তুচ্ছ ব্যক্তিগত বাসনা চরিতার্থের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করার জন্য নয়।
শক্তির উৎস
আমাদের কামনা এমন কিছুর জন্য হওয়া উচিত যা আমাদের শক্তিমান করে—শক্তিমান করে আচম্বিত আঘাত—বিশৃঙ্খলা, অনিশ্চয়তা প্রভৃতির সম্মুখীন হতে। এই শক্তি জড় উপাদানের উপর নির্ভরশীল নয়, তা নির্ভর করে মানসিক ক্ষমতা ও ভারসাম্যের উপর।


অমৃতকথা 


আহা, দেশে গরিব-দুঃখীর জন্য কেউ ভাবে না রে! যারা জাতির মেরুদণ্ড, যাদের পরিশ্রমে অন্ন জন্মাচ্ছে, যে মেথর-মুদ্দাফরাশ একদিন কাজ বন্ধ করলে শহরে হাহাকার রব ওঠে— হায়! তাদের সহানুভূতি করে, তাদের সুখে-দুঃখে সান্ত্বনা দেয়, দেশে এমন কেউ নেই রে! এই দেখ্‌ ঩না—হিন্দুদের সহানুভূতি না পেয়ে মাদ্রাজ-অঞ্চলে হাজার হাজার পারিয়া কৃশ্চান হয়ে যাচ্ছে। মনে করিসনি কেবল পেটের দায়ে কৃশ্চান হয়, আমাদের সহানুভূতি পায় না বলে। আমরা দিনরাত কেবল তাদের বলছি— ‘ছুসনে’। দেশে কি আর দয়াধর্ম আছে রে বাপ্‌! ঩কেবল ছুৎমার্গীর দল! অমন আচারের মুখে মার ঝাটা, মার লাথি। ইচ্ছা হয়, তোর ছুঁৎমার্গের গণ্ডি ভেঙে ফেলে এখনি যাই—‘কে কোথায় পতিত-কাঙাল দীন-দরিদ্র আছিস’ বলে তাদের সকলকে ঠাকুরের নামে ডেকে নিয়ে আসি। এরা না উঠলে মা জাগবেন না....দে সকলে মিলে এদের চোখ খুলে। আমি দিব্য চোখে দেখছি, এদের ও আমার ভেতর একই ব্রহ্ম— একই শক্তি রয়েছেন, কেবল বিকাশের তারতম্য মাত্র সর্বাঙ্গে রক্তসঞ্চার না হলে কোন দেশে কোনও কালে কোথায় উঠেছে দেখেছিস?
একটার অঙ্গ পড়ে গেলে, সবল থাকলেও ঐ দেহ নিয়ে কোন বড় কাজ আর হবে না— এ নিশ্চয় জানবি।... আমি এত তপস্যা করে এই সার বুঝেছি যে, জীবে জীবে তিনি অধিষ্ঠান হয়ে আছেন; তা ছাড়া ঈশ্বর-ফিশ্বর কিছুই আর নেই।— ‘জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর’।
আমাদের এই দেশে— বেদান্তের এই জন্মভূমিতে সাধারণ লোককে বহু শতাব্দী যাবৎ এইরুপ মায়াচক্রে ফেলিয়া ভ্রমণ হীনভাবাপন্ন করিয়া ফেলা হইয়াছে। তাহাদের স্পর্শে অশুচি, তাহাদের সঙ্গে বসিলে অশুচি! তাহাদিগকে বলা হইতেছে, ‘নৈরাশ্যের অন্ধকারে তোদের জন্ম— থাক চিরকাল এই নৈরাশ্যের অন্ধকারে।’ ফল এই হইয়াছে যে, সাধারণ লোক ক্রমশঃ ডুবিতেছে, গভীর হইতে গভীরতর অন্ধকারে ডুবিতেছে, মনুষ্যজাতি যতদূর নিকৃষ্ট অবস্থায় পৌঁছিতে পারে, অবশেষে ততদূর পৌঁছিয়াছে। কারণ এমন দেশ আর কোথায় আছে, যেখানে মানুষকে গো-মহিষাদির সঙ্গে একত্র বাস করিতে হয়? আর ইহার জন্য অ­­পর কাহারও ঘাড়ে দোষ চাপাইও না—অজ্ঞ ব্যক্তিরা যে ভুল করিয়া থাকে, তোমরা সেই ভ্রমে পড়িও না। ফলও হাতে হাতে দেখিতেছ, তাহার কারণও এইখানে বর্তমান। বাস্তবিক দোষ আমাদেরই। সাহস করিয়া দাঁড়াও, নিজেদের ঘাড়েই সব দোষ লও, অন্যের স্কন্ধে দোষারোপ করিতে যাইও না, তোমরা যে-সকল কষ্ট ভোগ করিতেছ, সেগুলির জন্য তোমরাই দায়ী।
‘ছুঁয়ো না, ছুঁয়ো না’ করে ছুঁৎমার্গীর দল দেশটাকে ঝালাপালা করেছে। তাও ভালমন্দ লোকের বিচার নেই; গলায় একগাছা সুতো থাকলেই হলো, তার হাতে অন্ন খেতে ছুঁৎমার্গীদের আর আপত্তি নেই। ...তোদের যত কিছু ধর্ম এখন দাঁড়িয়েছে গিয়ে ভাতের হাঁড়ির মধ্যে! অপর জাতির ছোঁয়া ভাতটা না খেলেই যেন ভগবান-লাভ হয়ে গেল! শাস্ত্রের মহান সত্যসকল ছেড়ে কেবল খোসা নিয়েই মারামারি চলছে। ...আমার কথা হচ্ছে তুই বামুন, অপর জাতের অন্ন নাই খেলি, কিন্তু তুই সব বামুনের অন্ন কেন খাবিনি। তোরা রা‌ঢ়ীশ্রেণী বলে বারেন্দ্র বামুনের অন্ন খেতে আপত্তি হবে কেন? আর বারেন্দ্র বামুনই বা তোদের অন্ন খাবে না কেন? মারাঠী, তেলেঙ্গী বা কনোজী বামুনই বা তোদের অন্ন খাবে না কেন? কলকাতার জাতিবিচারটা আরও কিছু মজার। দেখা যায় অনেক বামুন-কায়েতই হোটেলে ভাত মারছেন; তাঁরাই আবার মুখ পুঁছে এসে সমাজের নেতা হচ্ছেন; তাঁরাই অন্যের জন্য জাত-বিচার ও অন্নবিচারের আইন করছেন! বলি—ঐসব কপটীদের আইনমত কি সমাজকে চলতে হবে? ওদের কথা ফেলে দিয়ে সনাতন ঋষিদের শাসন চালাতে হবে, তবেই দেশের কল্যাণ।
ধর্ম কি আর ভারতে আছে দাদা! জ্ঞানমার্গ, ভক্তিমার্গ, যোগমার্গ সব পলায়ন, এখন আছে কেবল ছুঁৎমার্গ— আমায় ছুঁয়ো না, আমায় ছুঁয়ো না। দুনিয়া অপবিত্র, আমি পবিত্র। সহজ ব্রহ্মজ্ঞান! ভাল মোর বাপ!! হে ভগবান! এখন ব্রহ্ম হৃদয়কন্দরেও নাই, গোলকেও নাই, সর্বভূতেও নাই— এখন ভাতের হাঁড়িতে।
স্বামী বিবেকানন্দের ‘জাতি সংস্কৃতি ও সমাজতন্ত্র’ থেকে 

কর্ম সম্বন্ধে সাধারণ লোকের স্পষ্ট ধারণা না থাকিলেও ইহা অধিকাংশ লোকেই বিশ্বাস করে যে এই সংসার প্রপঞ্চের এবং ব্যাপক দুঃখ জঞ্জালের মূল একমাত্র কর্ম। এই বিশ্বাস যে অমূলক তাহা নহে। তবে ইহা স্পষ্টরূপে বোধগম্য হওয়া উচিত। যে কর্মের প্রভাবে সংসারে সুখ দুঃখ উত্‌পন্ন হয় তাহা অজ্ঞানমূলক কর্ম। অজ্ঞান অথবা অবিদ্যাই সংসারের মূল। অবিদ্যা, অস্মিতা, রাগ-দ্বেষ ও অভিনিবেশ—এই পাঁচটি ক্লেশের মধ্যে অবিদ্যাই মূল ক্লেশ। অবিদ্যা হইতে অস্মিতা অথবা অহংভাবের উদয় হয়। এই উদয়ের ফলে অবস্থা অনুসারে চিত্তে রাগ-দ্বেষ জন্মে এবং তাহার পর অভিনিবেশ বা মৃত্যুভয় উত্পন্ন হয়। অবিদ্যা প্রভৃতি পাঁচটি ক্লেশ সাংসারিক জীবনের মূলস্তম্ভস্বরূপ। অবিদ্যা বলিতে এখানে অবিবেক বুঝিতে হইবে। যে বস্তু যাহা নয় তাহাকে তাহাই মনে করা অবিদ্যা এবং মিথ্যাজ্ঞান হইতেই অস্মিতা বা অহংভাবের উদয় হয়। সত্তা ও চৈতন্য এই উভয়ের মধ্যে যে পার্থক্য তাহা বোধে না নিয়া উভয়কে একরূপ মনে করা ইহাই অস্মিতা এবং ইহারই নামান্তর ‘অহম্ভাব’। এই অহম্ভাব হইতে আকর্ষণ ও বিকর্ষণ অর্থাত্‌ রাগ-দ্বেষ উভয়ই উত্‌পন্ন হয়। স্থূল দেহের পরিত্যাগের আশঙ্কাকে অভিনিবেশ বলে। এই অবিদ্যাদি পঞ্চক্লেশ ইহা হইতে উদ্ভূত কর্ম। কর্ম হইতে বিপাক উত্‌পন্ন হয়। বিপাক বলিতে জন্ম, আয়ু ও ভোগ এই তিনটি বুঝিতে হইবে এবং চরমে কর্মাশয় নামক সংস্কার উত্‌পন্ন হয়। কর্মাশয় অনুসারে সুখঃ-দুঃখ নিয়ন্ত্রিত হয়। ক্লেশ, কর্ম, বিপাক এবং কর্মাশয় সংসারী আত্মা মাত্রেই থাকে কিন্তু ঈশ্বরের এসব নাই। ক্লেশ হইতে অর্থাত্‌ অ঩বিদ্যাদি ক্লেশের প্রভাবে যে কর্ম উদ্ভূত হয় তাহাই ক্লিষ্ট কর্ম। অবিদ্যার মূল স্বরূপ অবিবেক অর্থাত্‌ পুরুষ ও প্রকৃতির পার্থক্য বুঝিতে না পারা। যোগমার্গে প্রবিষ্ট পুরুষ বিবেক-খ্যাতির আভাস করেন। পুরুষ ও প্রকৃতির অভেদ জ্ঞানকে আশ্রয় করিয়া যে কর্ম হয় তাহাই ক্লিষ্ট কর্ম।
বিবেকখ্যাতিকে পৃষ্ঠভূমিতে রাখিয়া যে কর্ম উত্‌পন্ন হয় তাহার নাম অক্লিষ্ট কর্ম। অবিবেকমূলক কর্ম নানা প্রকার হইতে পারে। শ্রেণীবিভাগ করিবার সময় এইগুলি শুল্ক, কৃষ্ণ ও মিশ্র এই তিন শ্রেণীতে বিভক্ত হয়। এইগুলি সবই সাংসারিক কর্ম। এইসব কর্মের ফলে সংসারবন্ধন ক্রমশঃ দৃ‌ঢ় হয়। কিন্তু বিবেকখ্যাতিমূলক কর্ম হইতে সংসারবন্ধন ক্রমশঃ শিথিল হইয়া যায়। যোগিগণ, শুল্ক, কৃষ্ণ ও মিশ্র নামে প্রধানতঃ তিন প্রকারে কর্ম বিভাগ করিয়া থাকেন। তাহার পর বিবেকখ্যাতি হইয়া গেলে ঐ জাতীয় কর্মের অবসান ঘটে। তখনকার কর্মের নাম অশুক্ল-অকৃষ্ণ। ঐ সকল কর্মে সংসারবন্ধন তো হয়ই না বরং পূর্বাস্থিত বন্ধন কাটিয়া যায়। যোগীর কর্ম অশুক্ল-অকৃষ্ণ, তাই ঐ কর্মের প্রভাবে সংসারোত্‌পাদক মিশ্র কর্ম, শুক্লকর্ম এবং কৃষ্ণকর্ম এবং অশুক্ল-অকৃষ্ণ কর্ম পরস্পরবিরোধী। শুক্ল ও কৃষ্ণ কর্মে যেমন মিশ্রণ হয় না তেমনি অশুক্ল-অকৃষ্ণ কর্মের সহিত শুক্ল কর্মেরও মিশ্রণ হয় না। শুক্লের সঙ্গে কৃষ্ণ থাকিলেও সান্নিধ্য বশতঃ শুক্ল কৃষ্ণ হয় না। ঠিক এই প্রকার অশুক্ল-অকৃষ্ণ সঙ্গে শুক্ল ও কৃষ্ণ কর্মের মিশ্রণ হয় না। ইহাই কর্ম-বিজ্ঞানের রহস্য। ইহা সংরক্ষিত না থাকিলে অনাদি সংসারের মধ্যে এক অবস্থা হইতে অন্য অবস্থায় পরিণতি হইতে পারিত না। ক্লিষ্ট কর্ম সংসারজনক কিন্তু অক্লিষ্ট কর্ম সংসারনাশক। পরমেশ্বরের স্বরূপে কোন প্রকার কর্মেরই স্পর্শ নাই। কর্মবিজ্ঞান অতি জটিল রহস্য স্বরূপ। ইহা মত্‌স্যজীবির জালের মত। অনাদিকাল হইতে ক্লিষ্ট কর্মের ধারা চলিয়া আসিতেছে। বিবেকখ্যাতি পূর্ণ না হইলে এই ধারার বিশ্রান্তি নাই। কর্মাশয় ক্লিষ্ট কর্ম হইতে উত্‌পন্ন হয়। অক্লিষ্ট হইতে হয় না।

ধন্যবাদ -
26th  May,


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ