বৈষ্ণব পদাবলী মাথুর, আক্ষেপানুরাগ ও প্রেম বৈচিত্ত্যের বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলী।


বৈষ্ণব পদাবলী : মাথুর কাকে বলে? 

আক্ষেপানুরাগ কী?

এবং পদাবলী বিষয়ক কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন 

উত্তর।

Gouranga Mahaprabhu
G0uranga Mahaprabhu

মাথুর :
দেশান্তর গমনের কারণে বিচ্ছিন্ন নায়ক-নায়িকার হৃদয়ে যে বিরহ বেদনা সৃষ্টি হয়,সেই বেদনাকেই মাথুর বল।বৈষ্ণব পদাবলীতে কৃষ্ণ চলে যাবার পর আর কখনো বৃন্দাবনে ফিরে না আসার পরিনামে  তার সঙ্গে রাধার যে চিরবিচ্ছেদ সেই বিচ্ছেদ কে কেন্দ্র করে মাথুর পর্যায়ের পদ গুলি লেখা। মাথুর এর অপর নাম বিরহ বা প্রবাস।


ব্রজলীলায় রাধাকে বৃন্দাবনে পরিত্যাগ করে শ্রীকৃষ্ণ মথুরা চলে যান। তার ফলে রাধার যে হৃদয়ভেদী বিরহ বেদনা,সেই মর্মস্পর্শী রাধা বিরহ বেদনা বিষয়ক পদকেই
সাধারণভাবে মাথুর বলা হয়।বৈষ্ণব রসশাস্ত্র অনুযায়ী বিপ্রলম্ভ শৃঙ্গারের চার প্রকার ভেদ আছে।যথা - পূর্বরাগ,মান,প্রেমবৈচিত্র ও প্রবাস।প্রবাস আবার দুই প্রকার - সুদূর প্রবাস ও অদূর প্রবাস।মাথুর এই সুদূর প্রবাসের অন্তর্গত।বৃন্দাবন অন্ধকার করে কৃষ্ণ কংসবধের নিমিত্ত মথুরায় চলে যাবার পর নন্দ ও যশোদা, শ্রীদাম-সুদাম এবং সর্বোপরি শ্রীরাধা নিদারুণ শোকে ও হাহাকারে আচ্ছন্ন হল। সেই নিদারুণ শোকাচ্ছ্বাস ও সেই পাষাণ বিগলিত করা  করুন ভাবালম্হনে বৈষ্ণব পদকর্তাগণ সৃষ্টি করে গেছেন হৃদয়দ্রাবি মাথুর পদাবলী।'

উজ্বলনীলমণি' বর্ণিত রাধার বিরহের দশটি দশা মাথুর পদে জীবন্তভাবে ধরা পড়েছে। মাথুরের পদ বলা বাহুল্য বিরহের পদ,তবে বিরহ পদাবলীর সঙ্গে মাথুর পদাবলীর
একটু পার্থক্য আছে।বিরহের পর আছে মিলনের সম্ভাবনা কিন্তু মাথুরের পর শ্রীরাধিকার মিলন সম্ভাবনা নেই।কেননা কৃষ্ণ মথুরা থেকে ব্রজধামে আর কখনোই প্রত্যাবর্তন করেননি। এদিক থেকে মাথুরের  যে বিরহ সীমাহীন, অন্তহীন বিরহের এক অতলান্ত পারাবার। এই কারণে বিরহের বিরহের পদ অপেক্ষা মাথুরে পদ অনেক বেশি কারুণ্যমন্ডিত ও চিত্তস্পর্শী।
মাথুরের পদগুলী বিশ্লেষণ করলে এর  আধ্যাত্বিক তাৎপর্যটি সহজেই উপলব্ধি করা যায়।কৃষ্ণ পরমাত্মা এবং রাধা জীবাত্মার প্রতিনিধি।মাথুর পদে রাধার যে মর্মস্পর্শী ক্রন্দন,তার মধ্যে প্রতিধ্বনিত হয়েছে পরমাত্মার জন্য জীবাত্মার এক সীমাহীন আর্তি ও হাহাকার।অর্থাৎ মাথুরের পদ একই সঙ্গে ভূমির ও ভূমার।মাথুর পদে তাই রাধা বিরহের যে বুক ভাঙ্গা বেদনার্তি,তা ঈশ্বর বিরহকাতর মানবাত্মার দীর্ণ হৃদয়ের এক শাশ্বত আলেখ্য। মাথুর পদের বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণার্থে 'মৈথিল কোকিল' বিদ্যাপতির দুটি মাথুর পর্যায়ের পদ আলোচিত হলো। প্রথমেই "অব মথুরাপুর মাধব গেল।কৃষ্ণ মথুরায় চলে গেছেন।কৃষ্ণ বিরহিনী শ্রীরাধা অন্ধকার বৃন্দাবন ভূমিতে বসে কাঁদছেন আর বলছেন - 

                                                "অব মথুরাপুর মাধব গেল।
                                          গোকুল-মানিক কো হরি নেল।।
                                          গোকুলে উছলল করুণাক রোল
                                           নয়ন জলে দেখ বহয়ে হিল্লোল।।

বৃন্দাবনের যিনি শ্রেষ্ঠ্য রত্ন,বৃন্দাবনের আনন্দের যিনি উৎস,তিনি মথুরায় চলে যাবার পর রাধার কন্ঠে এই শোকাচ্ছ্বাসইতো স্বাভাবিক।কে সেই 'গোকুল মানিক' কে আজ হরণ করে নিল।তার বিরহে সমগ্র গোকুল আজ উথলে উঠেছে সকরুণ কান্নার রোল। বৃন্দাবন বাসীদের দুই নয়নের জলধারায় কৃষ্ণ বিরহী বৃন্দাবন আজ পরিপ্লাবিত।রাধা বলছেন - কৃষ্ণ বিহনে সৃষ্টি হয়েছে এক অন্তহীন শূন্যতা।যিনি পূর্ণ তার বিরহে এই শূন্যতাতো অনিবার্য।রাধার বিরহ বিদীর্ণ হৃদয় আজ তাই বলে -

                                            "শূন ভেল মন্দির শূন ভেল নগরী।
                                             শূন ভেল দশ দিশ শূন ভেল সগরী।।
                                             কৈছনে যায়ব  যমুনা তীর।
                                             কৈছনে নেহারব কুঞ্জ-কুটীর।।"

 শুধু গোকুলনগরী শূন্য নয়,শুধু কুঞ্জ কুটীর শূন্য নয়,রাধার কাছে এক অপার শূন্যতায় ভরে গেছে দশদিগন্ত,সমস্ত কিছু। তাই তার ভাবনা কেমন করে তিনি আজ যমুনা তীরে যাবেন।কেমন করে দেখবেন এবং সহ্য করবেন কৃষ্ণ বিহীন কুঞ্জ কুটিরের সীমাহীন শূন্যতা।তবে বিদ্যাপতির আলোচ্য পদটি  আস্বাদন করলে দেখা যায় রাধার এই বিরহ বেদনা বিমিশ্র কা্য মন্ডিত নয়- এর ভিতরে যেন এক ধরনের আনন্দেরও স্পর্শ রয়েছে। তবে বিদ্যাপতির অপর মাথুর পদটির সম্পর্কে এ কথা বলা যায় না।পদটি হল বিদ্যাপতির এই পর্যায়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ও সুপ্রসিদ্ধ ' এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর।'  এখানে দেখছি রাধার বিরহ বেদনা যেন আকাশকে স্পর্শ করেছে।তিনি বলছেন :

                                          "এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর।
                                        এ ভরা বাদর                মাহ ভাদর
                                                     শূন্য মন্দির মোর।।
                                          ঝম্পি ঘন গর             জন্তি সন্ততি
                                                   ভূবন ভরি বরিখন্তিয়া।
                                          কান্ত পাহুন             কাম দারুণ
                                                   সঘনে খর সর হন্তিয়া।।'

 রাধার দুঃখের অন্ত নেই,ভরা ভাদ্র মাস,বর্ষণমুখর রজনী - এইতো প্রিয় মিলনের শ্রেষ্ঠতম লগ্ন।কিন্তু হায় ! অভাগী রাখার মন্দির আজ শূন্য - 'শূন্য মন্দির মোর।' ঘনঘন বজ্রপাত হচ্ছে দেখা যাচ্ছে দুরন্ত মেঘ গর্জন,ভূবন ভাসানো বৃষ্টিধারায় চতুর্দিক পারিপ্লাবিত আর সুতীব্র বিরহ-শোকে রাধার হৃদয় বিদীর্ণ হয়ে যাচ্ছে।বর্ষা প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে রাধা বলছেন :

                                         "কুলিশ শত শত                পাত-মোদিত
                                                           ময়ূর নাচত মাতিয়া।
                                            মত্ত দাদুরী                       ডাকে ডাহুকী
                                                          ফাটি যাওত ছাতিয়া ।।"

আনন্দে নৃত্য করছে ময়ূর,ব্যাঙের ডাকশোনা যাচ্ছে,ডাকছে ডাহুক পাখিরা আর তাদের উচ্ছ্বসিত পুলকের বিপ্রতীপে বিরহিনী শ্রীরাধার 'ফাটি যাওত ছাতিয়া'।ঘন তিমিরময়ী রজনীতে নিঃসঙ্গ নিশীতে রাধার এই অন্তহীন বিরহ বেদনা লীলাময়-প্রেমময় শ্রী হরির জন্য ভক্ত প্রাণের বিরহবেদনাকেই ক্ষণে ক্ষণে মনে করিয়ে দেয়। তার স্পষ্টতর  ইঙ্গিত আছে পদটির শেষ দুই চরণে :

                                          তিমির দ্বিগ ভরি                     ঘোর যামিনী
                                                           অথির বিজুরিক পাঁতিয়া।
                                          বিদ্যাপতি কহ                        কৈছে গোঙায়বি
                                                           হরি বিনে দিন রাতিয়া ।।"

ঘোর অন্ধকার কালো মেঘের বুক চিরে ঝলকিত হচ্ছে ক্ষণপ্রভা।এহেন সময়ে হরি বিহনে কেমন করে কাটবে দিনরাত্রি?"কৈছে গোঙায়বি হরি বিনে দিন রাতিয়া।"এখানে স্পষ্টতই হরিভক্তি পরায়ণ মানবতার ঈশ্বর বিরহের কথাই অভিব্যঞ্জিত। 
অতএব মাথুরের পদ গুলি আলোচনা করে দেখা গেল,রাধার হৃদয় দর্পণে প্রতিফলিত হয়েছে জীবাত্মা হৃদয় দর্পণে প্রতিবিম্বিত হয়েছে জীবাত্মারই হৃদয়ব্যাকুলতা এবং মর্মস্পর্শী ভাষা-ছনটদ সুরে ধ্বনিত হয়েছে পরমপুরুষের জন্য নিখিল মানবত্মার বক্ষোভেদী আর্তনাদ। 

আক্ষেপ অনুরাগ ও প্রেমবৈচিত্ত্য কাকে বলে?

 নন্দকিশোর দাসের 'রসপলিতা' য় আক্ষেপ অনুরাগ বিষয়ে বলা হয়েছে :

                                       কৃষ্ণকে মুরলীকে আক্ষেপ দূতিকে করায়।
                                       কভু বা আক্ষেপ উক্তি গুরুজনে হয়।।
                                       কুলে শীলে আক্ষেপ কখনো বিধাতাকে।
                                       জাতিকে আক্ষেপ কভু,কভু আপনাকে।
                                       কন্দর্পকে নিন্দা, কভু আক্ষেপ সখিরে।

উল্লাস আক্ষেপ রূপ ধরিল বিচারে।।উদ্ধৃতাংশে আক্ষেপানুরাগের লক্ষণগুলি সুস্পষ্টভাবে ধরা পড়েছে। রাধা কখনো কৃষ্ণকে, কখনো কৃষ্ণের বাঁশিকে,কখনো গুরুজনকে, কখনো নিজের নারীত্বকে কখনো বা নিজের বংশ মর্যাদা এবং রতিদেব কন্দর্পের উপর আক্ষেপউক্তি করেন।এইভাব অবলম্বনে রচিত পদগুলি আক্ষেপ অনুরাগের পদ বলে পরিচিত। অর্থাৎ কৃষ্ণকে ভালোবেসে রাধার যে দুঃখ- জ্বালাভোগ,আক্ষেপানুরাগের পদ তারই সুমধুর অভিব্যক্তি।

'প্রেমবৈচিত্ত্য' শব্দটি প্রেমবৈচিত্র শব্দটির সঙ্গে সাদৃশ্যবসতত অনেকের কাছে সমার্থক বলে বোধ হয় কিন্তু এই ধারণা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। 'চৈতন্যচরিতামৃত' -এর মধ্যলীলার অষ্টম পরিচ্ছেদ কবিরাজ গোস্বামী জানিয়ে গেছেন :

                                        "সৌভাগ্য তিলক চারু ললাটে উজ্জ্বল। 
                                         প্রেমবৈচিত্ত্য -রত্ন হৃদয়ের তরল।।"
অর্থাৎ প্রিয়জন নিকটে থাকলেও প্রেমের উৎকর্ষবশত যে বিচ্ছেদবোধ, তাকেই বলে প্রেমবৈচিত্ত্য।চন্ডীদাসের - 'দুহুঁ কোরে দুহুঁ কান্দে বিচ্ছেদ ভাবিয়া' এই সুপ্রসিদ্ধ পংক্তিটি প্রেমবৈচিত্ত্যের চমৎকার দৃষ্টান্ত। রাধা ও কৃষ্ণ উভয়েই উভয়ের নিকটে -পরস্পরের ক্রোড়ে আবদ্ধ আছেন। তথাপি প্রেমের অতুলনীয় গভীরতাবশত তারা উভয়েই বিচ্ছেদ বেদনায় ব্যাকুল।প্রণয়সুগভীর হলে তবেই নায়ক-নায়িকার মধ্যে ঘনিষ্ঠ নৈকট্য সত্ত্বেও বিচ্ছেদবোধ জেগে ওঠে।নিকটে থেকেও দূরে থাকার এই বোধ বা অনুভূতিকে রূপ গোস্বামী তাঁর 'উজ্জ্বলনীলমণি' - তে প্রেমবৈচিত্ত্য বলে অভিহিত করেছেন।চন্ডীদাসের রাধা দয়িত কৃষ্ণের উদ্দেশে বলেছেন : 

                                           'কি মোহিনী জান বঁধু কি মোহিনী জান।
                                            অবলার প্রাণ নিতে নাহি তোমা হেন।।"

কৃষ্ণকে মনেপ্রাণে ভালবেসেও রাধা তাঁকে  পাননি।তাঁর এই দুঃসহ দুরবস্থা - অবলা নারীর মন হরণ করে তাকে কষ্ট দেওয়াই যেন কৃষ্ণের স্বভাব।তাই সরাসরি তিনি আক্ষেপোক্তি করেছেন কৃষ্ণের প্রতি। অসহায় রাধা বুকভাঙ্গা বেদনায় করুণ ভাষায় বলেছেন :

                                              'ঘর কৈনু বাহির,   বাহির কৈনু ঘর।
                                               পর কৈনু আপন,  আপন কৈনু পর।।
                                               রাতি কৈনু দিবস,  দিবস কৈনু রাতি।
                                               বুঝিতে নারিনু বন্ধু তোমার পিরী।।"

অর্থাৎ হে কৃষ্ণ তোমাকে পাওয়ার জন্য আমি কি না করেছি !গুরুজনদের নিন্দা সামাজিক লোক প্রবাদ ইত্যাদি সবকিছুই তুচ্ছ করেছি।পরিত্যাগ করেছি দুস্ত্যজ আর্য পথ।আমি ঘর ছেড়ে এসেছি বাইরে। আমার স্বভাব - সংস্কার আচরণ এমনকি প্রকৃতির বিধান পর্যন্ত বিপর্যস্ত করে অসাধ্যসাধন করেছি।আমার রাত্রি হয়ে গেছে দিন, দিন হয়ে গেছে রাত্রি।কিন্তু এত অসাধ্যসাধন করেও এত অবরেণ্যকে বরণ করেও আজ পর্যন্ত তোমার ভালোবাসার রীতি বুঝতে পারলাম না।
তথাপি যেমন একবার কৃষ্ণে সমর্থিত হয়েছে, সেই মনটিকে রাধা ফেরাতে পারেন না।পদটির পরবর্তী অংশে রাধার সেই  অনন্যোপায় অসহায়তারই এক হৃদয়স্পর্শী অভিব্যক্তি :

                                         " কোন বিধি সিরজিল সোতের শেঁওলি।
                                           এমন ব্যথিত নাই ডাকি বন্ধু বলি।।"

লক্ষণীয় রাধার আক্ষেপ এখানে আসলে নির্দয় বিধাতার প্রতি। জলস্রোতের শ্যাওলা যেমন আত্মকর্তৃত্ব হারিয়ে ভেসে যায়,যেদিকে প্রবাহ সেইদিকেই তাদের গতি- অর্থাৎ নিতান্ত অসহায়।আত্মসংবরণে অক্ষম রাধার অবস্থাও আজ তদ্রুপ।তাকে আজ সমবেদনা জানাবার মত কোন সহানুভূতিশীল বন্ধুও নেই।এমতাবস্থায় রাধার মরে যেতে ইচ্ছে হয়। যার জন্য তার এই সকরুণ অবস্থা তিনি যদি বিরূপ হন তবে বেঁচে থেকে কি লাভ।তাই চন্ডীদাসের কৃষ্ণগতপ্রাণা রাধাকে বলতে শুনি :

                                              "বধু যদি তুমি মোরে নিদারুণ হও।
                                               মরিব তোমার আগে দাঁড়াইয়া রও।।"

 একমাত্র তোমার মুখের দিকে চেয়েই বেঁচে আছি -  সেই তুমি যদি এই অভাগীর প্রতি নির্মম হও তবে দাঁড়াও, তোমার সামনে মৃত্যুবরণ করে এই জীবনের জ্বালা জুড়াব।চন্ডিদাস সহজ ভাবের সহজ ভাষার কবি। আলোচ্য পদটিতে আক্ষেপানুরাগিণী শ্রীরাধার সুগভীর মর্মবেদনাকে তিনি অসামান্য প্রাঞ্জল ভাষায় প্রকাশ করেছেন।
জ্ঞানদাস এখানে বলছেন : অচলে আরোহন করতে গিয়ে দুর্ভাগিনী রাধা নিক্ষিপ্ত হয়েছেন অগাধ সমুদ্রসলিলে।রাধা তাই করুণকন্ঠে বলেছেন : 

                                          সুখের লাগিয়া                এ ঘর বাঁধিনু
                                                       আনলে পুড়িয়া গেল।
                                          আমিয়-সাগরে              সিনান করিতে
                                                       সকলি গরল ভেল।। 
                                                 সখি কি মোর করমে লেখি।
                                          শীতল বলিয়া                 ও চাঁদ সেবিনু
                                                       ভানুর কিরন দেখি।।

বাস্তবিক অভাগীর রাধার অশ্রুসিক্ত কন্ঠে হাহাকার ও বঞ্চনাসর্বস্ব জীবন-যৌবনের আর্তি ও আক্ষেপ যেন আকাশ ছুঁয়েছে। পদটিতে রাধা আরো বলেছেন,তিনি ঐশ্বর্য চেয়েছেন, কিন্তু তার বদলে পেয়েছেন অপরিসীম দারিদ্র্য,অজ্ঞানকৃত অবহেলায় দুর্লভ মাণিক হারিয়ে তিনি আজ সর্বরিক্তা। রাধার আক্ষেপ এই বাধা মানে না,তার মর্মের গভীর থেকে উতৎকলিত হয় :

                                      "নগর বসালাম                     সাগর বাঁধিলাম 
                                                        মাণিক পাবার আশে।

                                       সাগর শুকাল                      মাণিক লুকাল
                                                        অভাগীর করম-দোষে।।
                                       পিয়াস লাগিয়া                    জলদ সেবিনু
                                                        বজর পড়িয়া গেল।"

অভাগীর কর্মদোষে সাগর শুকিয়ে যায়,পিয়াসার জল চাইলে মেঘে থেকে বজ্রপাত হয়। জ্ঞানদাসের আলোচ্য পদটি বিশ্লেষণ করে দেখা গেল বিষম অলংকারের প্রয়োগ কুশলতায় রাধার মর্মান্তিক আক্ষেপ এখানে নিপুণভাবে ফুটে উঠেছে।তবে লক্ষণীয় উচ্চরব হাহাকার অপেক্ষা অশ্রুভেজা কণ্ঠে বিষণ্ণ আক্ষেপই এখানে বড় হয়ে উঠেছে।কাব্য গুণের দিক দিয়ে এই পদটিও অসাধারণত্বের দাবিদার।

পদাবলী বিষয়ক কিছু প্রশ্ন উত্তর  :
বৈষ্ণব পদাবলীতে কয় প্রকার নায়িকা আছে ও কি কি?


বৈষ্ণব পদাবলীতে আট প্রকার নায়িকা দেখতে পাওয়া যায়। যথাঃ -

১। অভিসারিকা : নায়িকা নিজে অভিসার করালে বা নায়ককে অভিসার করালে তাকে অভিসারিকা বলে।

২। বাসকসজ্জিকা : নায়কের সঙ্কেত মত নায়িকা নির্দিষ্ট স্থানে অভিসার করে বাসকসজ্জায় কুঞ্জ সাজিয়ে নিজে সাজ-সজ্জা করে নায়েকের অপেক্ষা করলে তাকে বাসকসজ্জিতা বলে।

৩। উৎখন্ডিতা : নায়কের আগমনে বিলম্ব হলে তাহলে নায়িকার মনে যে উৎকণ্ঠা জাগে এই ধরনের নায়িকাকে উৎকণ্ঠিতা বলে।

৪। বিপ্রলব্ধা : কুঞ্জবনে নায়িকা সাজসজ্জা করে নায়কের অপেক্ষায় আছেন অথচ নায়ক এলেন না,এই কারণে নায়িকার মনে যে করুন বেদনা জাগে, তাকে বলা হয় বিপ্রলব্ধা।

৫। খন্ডিতা :  কুঞ্জবনে নায়েকের প্রতীক্ষায় নায়িকা সারা রাত্রি জেগে কাটালেন। অবশেষে প্রভাতে যখন নায়কের দেখা পাওয়া গেল তখন নায়িকা দেখলেন তার সারা শরীরে অন্য নায়িকার কুঞ্জে রাত্রি যাপনের চিহ্ন রয়েছে।এই অবস্থায় নায়িকার মনে যে তীব্র যন্ত্রণার সৃষ্টি হয় তাকে বলা হয় খন্ডিতা।

৬। কলহান্তরিতা : অন্য নায়িকার গৃহে রাত্রি যাপনের জন্য নায়িকা ঝগড়া করে নায়ককে তাড়িয়ে দিলেন। নায়ক চলে যাবার পর নায়িকার মনে যে গভীর অনুতাপ ও যন্ত্রণার সৃষ্টি হয়,সেই অবস্থার নাম কলহান্তরিতা।

৭। পোষিতভর্তৃকা : নায়ক যখন দূর বিদেশে চলে যান তখন তার বিরহে কাতর নায়িকাকে বলা হয় প্রোষিতভর্তৃকা।

৮।স্বাধীনভর্তৃকা : নায়ককে যখন নায়িকা নিজের বশে রেখে স্বেচ্ছামত আচরণ করতে পারেন তখন তাকে বলা হয় স্বাধীনভর্তৃকা।

কিছু প্রশ্ন এবং উত্তর -


প্রশ্ন : গৌরচন্দ্রিকা কাকে বলে?

উত্তর : রাধা-কৃষ্ণ পালা কীর্তন শুরু করার প্রাক-মুহূর্ত যে রসের লীলাকীর্তন গাওয়া হবে তার সঙ্গে মিল আছে এরূপ গৌরাঙ্গ বিষয়ক পদগুলি যদি গাওয়া হয় তাহলে তাকেই গৌরচন্দ্রিকা বলা হয়।

প্রশ্ন : গৌরচন্দ্রিকা পদের উদ্ভাবক কে? কবে গৌরচন্দ্রিকা প্রথম গীত হয়েছিল?

উত্তর : এর উদ্ভাবক ছিলেন নরোত্তম ঠাকুর।
খেতুরির মহোৎসবে প্রথম গাওয়া হয়েছিল।

 প্রশ্ন : বৈষ্ণব পদাবলীতে রস কয় প্রকার ও কি কি?

উত্তর :  মুখ্য রস ও মধুর রস।

প্রশ্ন : জয়দেবের গীতগোবিন্দ কোন রাজসভার অভিনীত হয়েছিল?

উত্তর : মিথিলায় লক্ষনসেনের রাজসভায়।

প্রশ্ন : বৈষ্ণব পদাবলীর আদি কবির সম্মান কার প্রাপ্তি?

উত্তর : কবি জয়দেব গোস্বামীর।

প্রশ্ন : চৈতন্যের কোন গুরু বালগোপালের উপাসক ছিলেন?

উত্তর : মাধবেন্দ্র পুরী।

প্রশ্ন : চৈতন্যকে দশাক্ষর গোপাল মন্ত্রে কে প্রথম দীক্ষত করেন? 

উত্তর : মাধবেন্দ্র পুরীর  প্রধান শিষ্য ঈশ্বর-পুরি চৈতন্যকে গয়ায় দশাক্ষর গোপাল মন্ত্রে দীক্ষিত করেন।

প্রশ্ন : প্রাকচৈতন্য যুগের দুজন বৈষ্ণব পদকর্তা নাম কি?

উত্তর : চন্ডীদাস ও বিদ্যাপতি।

প্রশ্ন : চৈতন্য পরবর্তী যুগের দুজন বৈষ্ণব পদকর্তা নাম কি?

উত্তর : জ্ঞানদাস ও গোবিন্দদাস।

প্রশ্ন : চৈতন্য সমসাময়িক যুগের দুজন বৈষ্ণব পদকর্তা নাম কি?

উত্তর : বাসু ঘোষ ও যদুনন্দন।

প্রশ্ন : খেতুরির মহোৎসবের নেত্রী কে ছিলেন?

উত্তর : নিত্যানন্দ মহাপ্রভুর স্ত্রী জাহ্নবা দেবী। এই উৎসবটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৫৮৩ সালে।

প্রশ্ন : বৈষ্ণব পদাবলী কয় প্রকার ভাষায় লেখা ও কি কি?

উত্তর : বৈষ্ণব পদাবলী দুই রকম ভাষায় লেখা যথা - ব্রজবুলি ও বাংলা।

প্রশ্ন : অভিনব জয়দেব কে?

উত্তর : অভিনব জয়দেব হলেন বিদ্যাপতি।

প্রশ্ন : গোবিন্দ দাস কে দ্বিতীয় বিদ্যাপতি উপাধি কে দেন?

উত্তর : শ্রীনিবাস আচার্যের শিষ্য বল্লভ দাস।

প্রশ্ন : প্রথম বৈষ্ণব পদসংকলন গ্রন্থটির নাম কি?

উত্তর : বিশ্বনাথ চক্রবর্তীর 'ক্ষণদাগীতচিন্তামণি'।

প্রশ্ন : শ্রী চৈতন্যদেবের জন্ম ও মৃত্যু সাল কত?

উত্তর : পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষার্ধে ১৪৮৬ সালে চৈতন্যদেবের জন্ম হয় এবং তার মৃত্যু ঘটে ১৫৩৩ সালে। 

প্রশ্ন : রাধা ও কৃষ্ণের নাম প্রথম কোথায় পাওয়া যায়?

উত্তর : রাধার নাম প্রথম পাওয়া যায় হালের 'গাঁথা সপ্তশতী' তে এবং কৃষ্ণের নাম প্রথম পাওয়া যায় ঋকবেদে।

প্রশ্ন : চারজন মুসলিম বৈষ্ণব পদকর্তা নাম কী?

উত্তর: নাসির মাহমুদ, আকবর আলী, সৈয়দ আইনুদ্দীন,সৈয়দ সুলতান।

প্রশ্ন : মধুর রসের অপর দুটি নাম কী?

উত্তর : শৃঙ্গার রস ও উজ্জ্বল রস।

প্রশ্ন : পূর্বরাগ পর্যায়ের পদের শ্রেষ্ঠ পদকর্তা কে?

উত্তর : চন্ডীদাস।

প্রশ্ন : মাথুর পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ পদকর্তা কে? উত্তর : বিদ্যাপতি।

প্রশ্ন : অভিসার পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ পদকর্তা কে?

 উত্তর : গোবিন্দদাস কবিরাজ।

প্রশ্ন : জ্ঞানদাস কোন পর্যায়ের পদে সর্বাধিক  কৃতিত্ব দেখিয়েছেন?

 উত্তর :আক্ষেপানুরাগ পর্যায়ের পদে।

প্রশ্ন : বৈষ্ণব শব্দটির প্রথম উল্লেখ কোথায় পাওয়া যায়?

 উত্তর : মহাভারতের শান্তিপর্বে।

প্রশ্ন : বলরাম দাস-এর গুরু কে?

উত্তর : নিত্যানন্দ মহাপ্রভু।

প্রশ্ন : গোবিন্দদাসের দীক্ষাগুরু কে ছিলেন? উত্তর : শ্রীনিবাস আচার্য।

প্রশ্ন : পদরত্নাবলী কাদের সংগ্রহ?

 উত্তর : রবীন্দ্রনাথ ও শ্রীশচন্দ্র মজুমদার এর সম্পাদনায় পদরত্নাবলী প্রকাশিত হয়।



ধন্যবাদ -

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ