বৈষ্ণব পদাবলী এবং পূর্বরাগ ও অভিসার। ( Baisanaba padabali, purbarug o abhisar )


বৈষ্ণব পদাবলী এবং পূর্বরাগ ও অভিসার।


বৈষ্ণব পদাবলী কীর্ত্তন

                                   বৈষ্ণব পদাবলী কীর্ত্তন


পদাবলী শব্দের অর্থ কী?

পদাবলী শব্দটির সাধারণত অর্থ পদসমষ্টি। জয়দেব তার ' গীতগোবিন্দম্, কাব্যে পদাবলী শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন।পদাবলীর বিষয়বস্তু মূলত রাধা কৃষ্ণের প্রেমলীলা। গীতগোবিন্দে সেই লীলার একটি অংশ বসন্তরাস রূপায়িত হয়েছে।


                           "মধুর কোমল কান্ত পদাবলীম
                              শৃনু তদা জয়দেব সরস্বতীম্।"

সপ্তম শতকের আলংকারিক আচার্য দন্ডী পদসমূহের অর্থে পদাবলী শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন -

                       " শরীরং অবদুষ্টার্থ ব্যবচ্ছিনা পদাবলী"

বাংলার বৈষ্ণব সমাজ সুদীর্ঘকাল ধরে পদাবলীকে কীর্তন গানের পর্যায়ভুক্ত করে এসেছেন।এখন শাক্ত গানও পদাবলী বলে কথিত।
পদাবলীর বিষয়বস্তু মূলত রাধা কৃষ্ণের পেমলীলা। গীতগোবিন্দে সেই লীলার একটি অংশ বসন্তরাস রূপায়িত হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথের কবিতাও " মধুর কোমলকান্ত পদাবলী" র কথা মনে করিয়ে দেয়।বাংলা সাহিত্যে পদাবলী দীর্ঘকাল থেকে প্রচলিত। প্রাকচৈতন্য যুগে জয়দেব, চন্ডীদাস, বিদ্যাপতি পদাবলী রচনা করেছিলেন। চৈতন্য - উত্তর যুগে অজস্র পদাবলী রচিত হয়েছে। পদাবলী রচয়িতাদের মধ্যে জ্ঞানদাস, গোবিন্দদাস,বলরামদাস উল্লেখযোগ্য হয়ে আছেন। বৈষ্ণ পদাবলী কেবল তত্ত্বগুণে নয়, সাহিত্য ও সঙ্গীতের গুণে এখনো পর্যন্ত বহু মানুষের রসাস্বাদনের কারণ হয়েছে।
পদাবলী পরবর্তীকালে কীর্তন গানের প্রধান বিষয় হয়ে পড়েছে এবং পালাবদ্ধ রস- কীর্তনের বিষয় রূপে পদাবলীকে কয়েকটি পর্যায়ে ভাগ করা হয়। এই রসপর্যায়ের  বিষয়টি অনেক সরে এসেছে।পদকর্তারা ভক্তি মূলক গ্রন্থ অবলম্বন করে পদাবলীতে তত্ত্বের প্রসঙ্গটি এনেছেন।পদাবলীর পর্যায় ভিত্তিক কীর্তনতত্ত্ব যা আজও প্রচলিত। তার প্রচলন করেন নরোত্তম দাস। তার আগে পদাবলী সাধারণতঃ পদাবলী রূপে গাওয়া যেত না।ষোড়শ শতকে খেতুরির মহোৎসবে এই রীতি প্রবর্তিত হয়।জয়দেবের সময় মিথিলা ও বঙ্গদেশেপদাবলী গানের যে রীতি প্রচলিত ছিল তার আধারে নরোত্তম দাস পদাবলী-কীর্তনের ঠাট বেঁধে দিয়েছিলেন।এরপর থেকে পালাবদ্ধ কীর্তন পদ্ধতিরপ্রচলন ঘটেছে।শ্রীরূপ গোস্বামীর 'ভক্তি রসামৃতসিন্ধু' ও উজ্বলনীলমণি' তে পদের বিষয় বিন্যাসের পরিচয় আছে।সপ্তদশ শতকের মধ্যভাগ থেকে পদাবলী সংকলনের কাজ শুরু হয় উনবিংশ শতকের উপক্রম পর্যন্ত এর কাজ চলতে থাকে। পদাবলীর বিষয়বস্তু সুনির্দিষ্ট।পালাবদদ্ধ কীর্তন গানের আসরে প্রথমে চৈতন্য বিষয়ক পদ গাওয়ার রীতি।খেতুরির মহোৎসবে গৌরচন্দ্রিকা পূর্ণ প্রতিষ্ঠা পায়।


পদাবলীকে কয়েকটি পর্যায়ে ভাগ করা হয়েছে। শুরু পূর্বরাগ দিয়ে  শেষ ভাবসম্মেলন বা ভাবোল্লাসে।পদাবলীর পরিকল্পনা বৈষ্ণব
তত্ত্বের রাধাকে অনুসরণ করে গৃহীত হয়েছে।পদাবলী যথেষ্ট গুরুত্ব পেয়েছে চৈতন্য-উত্তর কালে। চৈতন্যদেবকে অবলম্বন করে যেসব লীলামূলক পদ রচিত হয়েছিল সেগুলি রাধা কৃষ্ণের লীলার প্রতিফলন বিশেষ। গৌড়ীয় বৈষ্ণব তত্ত্বে  চৈতন্যদেবকে রাধাকৃষ্ণের যুগল বিগ্রহরূপে কল্পনা করা হয়েছে।

          ' সেই রাধার ভাবলঞা চৈতন্যাবতার।'

বৈষ্ণব কবিরা বিভিন্ন রসের মাধ্যমে রাধা কৃষ্ণের লীলা কাহিনী রচনা করেছেন। পূর্বরাগ থেকে পদাবলী শুরু। বৈষ্ণ ফদকর্তরি মধুর রসকে গুরুত্ব দিয়েছেন। ভক্তি রসের কাব্য পদাবলীতে
প্রেমভক্তিকেই সাধ্য বস্তু হিসেবে সর্বোত্তম বলা হয়েছে। পূর্বরাগের পদে শ্রীকৃষ্ণের প্রতি অনুরাগ। অভিসার পর্যায়ে নানা বাধা বিঘ্ন অতিক্রম করে সেই পরম স্বরূপ কৃষ্ণের সঙ্গে মিলনের উদ্দেশ্যে যাত্রা।প্রেম বৈচিত্তে প্রেমের গভীরতার ফলে  প্রিয় সন্নিধানে থেকেও বিরহবেদনা।মাথুরের কৃষ্ণকে হারিয়ে  সর্বশূণ্যতার অনুভূতিও হাহাকার এবং ভাব সম্মেলনে গভীর বেদনার পরম উপলব্ধির মধ্যে দিয়ে রাধার অন্তর্লোকে কৃষ্ণের সাথে মিলন বা কৃষ্ণ ধ্যানে রাধার তন্ময়তার মধ্য দিয়ে সাধনতত্ত্ব পরিণতি লাভ করেছে এবং রাধা কৃষ্ণের প্রণয়লীলার আধ্যাত্মিক তাৎপর্য এই পর্যায় বিভাগের মধ্যে জীবিত হয়ে উঠেছে।
রাধা কৃষ্ণের লীলা ধারায় উল্লিখিত পদগুলী ' ছাড়াও বাসকসজ্জা, খন্ডিতা, বিপ্রলব্ধা,কলহান্তরিতা,মান রসোদগার প্রভৃতি ধারার পদ আছে।এছাড়া আছে প্রার্থনা ও আত্ম নিবেদন মূলক পদ।
পূর্বরাগে প্রেমের প্রথম সঞ্চার ঘটতে দেখা যায়।ভগবত বিষয়ের রীতি কিভাবে এখানে ভক্ত ভগবানের প্রেমের সার্থকতা লাভ করেছে তা বিদ্যাপতির পদে ব্যক্ত হয়েছে-

      " আজু রজনী হাম             ভাগে পোহায়লুঁ
                         পেখলুঁ পিয়া মুখ চন্দা।
       জীবন যৌবন                    সফল করি মানলুঁ
                         দশদিশ ভেল নিরদন্দা।"

 বৈষ্ণব মহাজনেরা চৈতন্যদেবকে দেখেছিলেন রাধাকৃষ্ণের মিলিত বিগ্রহ রূপে-

             "রাধাকৃষ্ণ একাত্মা দুই দেহ ধরি।
              অন্যোন্যে বিলাস রস আস্বাদয়ে করি।।
              সেই দুই রূপ এব চৈতন্য গোসাঞি।
              রস আস্বাদিতে দোঁহে হৈলা এক ঠাঁই।।"

অবশ্যই পড়ুন - ধর্ম ও বিজ্ঞানের মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক 


বৃন্দাবনের রূপলীলায় বিরহ আছে।সেখানে দ্বৈত ব্যবধান কিন্তু ভালোলোকে বিরহ নেই। তাই সেই মিলন নিত্য।কয়েকটি পর্যায়ের মধ্যে দিয়ে বৈষ্ণব পদকর্তাদের রাধাকৃষ্ণের অলৌকিক সম্পর্কটি আধ্যাত্মিক ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত।লীলা শব্দের অর্থ নবরূপে ঈশ্বরের লীলা।সে দিক থেকে শ্রেষ্ঠ লীলা।বৈষ্ণব মহাজনেরা লীলামুখ।তারা রূপলোকের দ্বৈতলীলাকে ভাবলোকে  অদ্বৈত লীলায় পরিণত হতে দেখেছেন। বৈষ্ণব পদ গুলি এইভাবে লীলা পর্যায়ের মধ্যে দিয়ে আধ্যাত্মিক ভাবমন্ডিত হয়ে উঠেছে।


বৈষ্ণব পদাবলীর পর্যায় গুলির নাম কী?

পর্যায়গুলী হল - পূর্বরাগ, অভিসার, মিলন, মাথুর, ভাবসম্মিলন,আক্ষেপানুরাগ,নিবেদন প্রার্থনা প্রভৃতি।


 পূর্বরাগ কাকে বলে?

পূর্বরাগ কথাটির অর্থ হল ভালবাসার পূর্বরূপ। বৈষ্ণব পদাবলীর পূর্বরাগ থেকে পদাবলী শুরু। প্রেমের আরম্ভ থেকে প্রেমের পরিণতি পর্যন্ত শ্রী রূপ গোস্বামী প্রত্যেকটি স্তরের বিশ্লেষন করেছেন।শ্রীরূপ গোস্বামী তার উজ্জ্বলনীলমণি গ্রন্থে শৃঙ্গারকে দুই ভাগে ভাগ করেছেন।সম্ভোগ ও বিপ্রলম্ভ।আবার বিপ্রলম্ভকে চার ভাগে ভাগ করা হয়েছে - পূর্বরাগ,মান, প্রেমবৈচিত্ত্য এবং প্রবাস। সুতরাং বিপ্রলম্ভের প্রথম পর্যায় হল পূর্বরাগ। শ্রীরূপ গোস্বামী তাঁর উজ্জ্বলনীলমণি গ্রন্থে পূর্বরাগের সংজ্ঞায় বলেছেন -

         " রতির্যা সঙ্গমাৎ পূর্বং শ্রবনাদিজা।
    তয়োরূন্মীলতি প্রাজ্ঞৈঃ পূর্বরাগঃ স উচ্যতে।।"

প্রকৃত মিলনের আগে নায়ক নায়িকা পারস্পারিক দর্শনজাত মিলনেচ্ছাময় রতি উপযুক্ত সঞ্চারী ভাব ও অনুভব দ্বারা পুষ্ট হয়ে প্রকাশ পেলে তাকে পূর্বরাগ বলা হয়। দর্শন প্রত্যক্ষ হতে পারে,চিত্রে ও স্বপ্নেও হতে পারে,আবার শ্রবন হতে পারে,দূতি মুখে হতে পারে অথবা সঙ্গীতাদি থেকে।কৃষ্ণের বংশীধ্বনি শুনে রাধার পূর্বরাগের উদয়ও বৈষ্ণব কবিদের প্রিয় প্রসঙ্গ।আবার শ্রবণে পূর্বরাগের ব্যাপারটি চৈতন্য -পরবর্তী বৈষ্ণব সমাজে সমাদর লাভ করেছে।
পূর্বরাগ অবস্থায় সঞ্চারীভাব হল - ব্যাধি, শঙ্কা, শ্রম, নির্বেদ,চাঞ্চল্য,দৈন্য,চিন্তা,নিদ্রা,জাগরণ,বিষাদ,জরতা,উন্মাদ,মোহ এবং মৃত্যু।

পূর্বরাগের দশটি সামঞ্জস্য ভাগ -
লালসা,উদ্বেগ,তানব,কৃশতা, জড়িমা,বৈয়গ্র‍্য,ব্যাধি উন্মাদ,মোহ এবং মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে এই পূর্বরাগ দশ রূপ লাভ করেছে।
রাধা কৃষ্ণের মিলন পূর্ব অনুরতি পূর্বরাগ হলেও মিলন উত্তর অনুরতি পূর্বরাগ নয়। মিলন উত্তর অনুভুতিকে বলা হয় অনুরাগ।এই পর্যায়ে প্রেম গভীরতা পায়। পূর্বরাগ ও অনুরাগ হলো প্রেমের অবস্থা ভেদ।
'রসকল্পবল্লী'- তে এই প্রসঙ্গে বলা হয়েছে |

                "সঙ্গে নহে রাগ জন্মে কহি পূর্বরাগ,
             সঙ্গ পরে রাগ    সেই সেই অনুরাগ।"

এই অর্থে মিলনের পূর্বে যে রতি ভাব জাগে তাহল পূর্বরাগ এবং তারপরে পরিণত হয় অনুরাগে।পূর্বরাগ অর্থাৎ হৃদয় কমলে প্রথম উন্মেষ চেতনা।ইংরেজিতে পূর্বরাগ অর্থাৎ - Love at the first sight- অবশ্যই এই সংজ্ঞাটি বৈষ্ণব পদাবলীর সংজ্ঞার মত ব্যাপ্ত নয়।
পূর্বরাগ তিন প্রকার - সাধারণী, সামঞ্জস্য ও প্রৌঢ়। যে রতি গাঢ় নয় তা সাধারন রতি। কৃষ্ণকে দর্শন করে তার রূপ লাবণ্যে বিহল হয়ে সংরূপ কামনায় এই রতির জন্ম।বৈষ্ণবীয় ভাষায় একে বলে আত্মেন্দ্রিয় প্রীতি ইচ্ছা।শাস্ত্র মতে বিবাহের দ্বারা সম্ভোগের ইচ্ছাপূরণের আকাঙ্ক্ষা সত্যভামা ও রুক্মিনী কৃষ্ণ বিষয়ক রতি সামঞ্জস্য। প্রৌঢ় পূর্বরাগের এই দুই স্তর থেকে উচ্চ স্তরের এই রাগ স্বসুখ বাসনাহীন থাকে বলে একে বলা হয় 'কৃষ্ণেন্দু প্রীতি ইচ্ছা।' কৃষ্ণের প্রীতি ইচ্ছা পুরণ শ্রেষ্ঠ কেননা তা সমর্থা প্রৌঢ় পূর্বরাগের সমর্থা রতি প্রাধান্য।লোক ধর্ম দেহ ধর্ম বেদ ধর্ম সবকিছুতেই এতে তুচ্ছ মনে হয়। কৃষ্ণ সুখে সুখই এর একমাত্র লক্ষ্য।পূর্বরাগের পদকর্তা রূপে চন্ডীদাসের প্রাধান্য সর্বজনস্বীকৃত।


অভিসার কাকে বলে? অভিসারের আধ্যাত্মিক তাৎপর্য কি?

শ্রীরুপ গোস্বামীর উজ্জ্বলনীলমণি গ্রন্থ অভিসারে লক্ষণ নির্দেশ প্রসঙ্গে জানিয়েছেন -

"যাভি সারয়তে কান্তম স্বয়ং বাভি সরত্রপি।"


অর্থাৎ যে নায়িকা মন্মথ - বশিভূতা হয়ে কান্তকে দিয়ে অভিসার করায় অথবা নিজের কান্তের কাছে গমন করে,সেই নায়িকাই অভিসারিকা।
'অমরকোষ' - এও আছে এই দুই অভিসারের কথা :
"কান্তার্থিনী তুখা যাতি সংকেতং সা অভিসারিকা।"
 এর ব্যাখ্যা হিসেবে 'উজ্জ্বলচন্দ্রিকা' বলা হয়েছে -

     "অভিসার করায় কান্তে, নিজে অভিসারে।
      জ্যোৎস্না তমোযোগ্য বেশ অভিসারে ধরে।।
      লজ্জাতে সম্বরি অঙ্গ নিঃশব্দ ভূষণ।
      অঙ্গ ঝাঁপি চলে সঙ্গে সখী একজন ।।"

 মিনলনের উদ্দেশ্যে নায়কের প্রতি অনুরাগবশত নায়িকার এবং নায়িকার প্রতি অনুরাগ হেতু নায়কের সংকেতপূর্ণ নির্দিষ্ট স্থানে গমনকে অভিসার বলে।যে নায়িকা নিজে অভিসার করে বা নায়ককে দিয়ে অভিসার করায়, সেই নায়িকাই অভিসারিকা। বৈষ্ণব পদাবলীতে নায়িকার অভিসারীই প্রধান বিষয়। অলঙ্কারশাস্ত্রে গ্রীষ্মাভিসারিকা,বর্ষাভিসারিকা,দিবাভিসারিকা,নিশাভিসারিকা,জ্যোৎস্নাভিসারিকা, ইত্যাদি আট প্রকার অভিসারিকার কথা বলা হয়েছ যেমন - পীতাম্বর দাস ' রসমঞ্জরী' তে লিখে গেছেন  -

        "জ্যোৎস্না,তামসি,বর্ষা,দিবা অভিসার।।                     কুজ্ঝটিকা,তীর্থযাত্রা,উন্মত্তা,সঞ্চরা।"

আধ্যাত্মিক তাৎপর্য - অভিসার পর্যায়ের পদের একটি গভীর আধ্যাত্মিক তাৎপর্য নিহিত আছে। একটি পরম গভীর ভাগবত সাধনার তত্ত্ব অভিসার পদের সঙ্গে অচ্ছেদ্য ভাবে জড়িত।ঈশ্বর সাধনার পথ ক্ষুরধার সম সূক্ষ,সেই দুরহ পথে অভিযাত্রার জন্য চাই কঠোর কৃষ্ণ সাধনা,গভীর দুঃখ ও নিঃশঙ্ক সাহস।এই বিপদ বরণ,দুঃখ যন্ত্রণা ভোগ ও কৃচ্ছ্রসাধনর ভাবটি অভিসার পদে ওতপ্রোতভাবে ছড়িয়ে আছে।
ভগবান কৃষ্ণ আমাদের সংসার সীমা থেকে বহুদূরে গোকুলের কুঞ্জবনে বংশীবাদন করেছেন।সেই বংশীধ্বনি শ্রীরাধিকাকে পাগলিনী করে তোলে।তার গৃহ কাজে মন বসে না।রন্ধন এলোমেলো হয়ে যায়।বংশীধ্ননির মাধ্যমে দয়িত ঈশ্বরের সেই অমোঘ অঙ্গকে উপেক্ষা করেন রাধার সাধ্য কী।তিনি ঘর-সংসার, বিষয়,সম্পদ, লজ্জা, ভয় সব কিছু ফেলে রেখে পথে এসে দাঁড়ান। সব কিছু ফেলে রেখে ছোটেন অজানা অচেনা দুঃসাধ্য দুর্গম পথে।বস্তুতপক্ষে বৈষ্ণব রসশাস্ত্রে ও বৈষ্ণব পদাবলীতে অভিসার বলতে এই ভগবত অণ্বেষণকেই বোঝানো হয়েছে।শ্রীভগবান বৈকুন্ঠ বসে অহোরাত্র আমাদের আহবান করছেন। কিন্তু কামিনী-কাঞ্চনে আসক্ত,সাংসারিক ভোগ বাসনায় মানুষ এতই মত্ত যে সেই আহবান তার কানের ভিতরে দিয়ে মরমে প্রবেশ করে না।কিন্তু নিজেকে সেই আহ্বানের জন্য সর্বদা প্রস্তুত থাকতে হবে এবং পরমের সেই  আহবানে সর্বস্ব ত্যাগ করে তৎক্ষণাৎ ছুটে যেতে হবে।এই অভিসারীইতো মানবাত্মার অভিসার।বৈষ্ণব পদাবলীর অভিসার তাই লৌকিক নায়কের প্রতি লৌকিক নায়িকার নয় - পরমাত্মার উদ্দেশ্যে জীবাত্মার অভিসার মাত্র।
এ প্রসঙ্গে গোবিন্দদাসের 'কন্টক গাড়ি কমল সম পদতল ' পদটি সর্বপ্রথম আলোচনার দাবি রাখে।পদটিতে দেখেছি গোবিন্দ দাসের রাধা অভিসারের যাত্রার জন্য কঠিন সাধনার মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রস্তুত করছেন।কেননা কখন বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণের বাঁশী বেজে উঠবে তার কোন স্থিরতা নেই।

        "কন্টক গাড়ী             কমল - সম পদতল
                      মঞ্জীর চীরহি ঝাঁপি।
         গাগরি-বারি                ঢারি করি পপীছল
                      চলোতহি অঙঙ্গুলি চাপি
          মাধব তুয়া                 অভিসারক লাগি।।"

সেই মাধবের উদ্দেশ্যে অভিসারের জন্য রাধা দুরন্ত পথ অতিক্রম করেন।তিনি সমগ্র জামিনী জেগে কাটান।
প্রবল বর্ষণ মুখর অন্ধকার নিশীথে সেই নিদারুণ বারিধারা উপেক্ষা করে রাধা পথে নামেন।কিন্তু পরম দয়িতের কাছে পৌঁছানো তো সহজ নয়!পঙ্কিল পথ অজানা আশঙ্কায় ভরা।নীল-নিচোল দিয়ে কি অবিরাম বর্ষণকে রোধ করা যায়?

                "মন্দির বাহির কঠিন কপাট।
                  চলইতে শঙ্কিল পঙ্কিল বাট।।
                  তঁহি অতি দূরতর বাদর দোল।
                  বারি কি বারই নীল-নিচোল।।"

এমত অবস্থায় চারিদিকে ঘন ঘন বজ্রপাত হচ্ছে, বিদ্যুৎ ঝলসাচ্ছে ক্ষনে ক্ষনে,দশদিক ঘন অন্ধকারে ঢাকা :

                "ঘন ঘন ঝন ঝন বজর নিপাত।
                শুনইতে শ্রবণে মরম জরি যাত।।
                দশ দিশ দামিনী দহন বিথার।
                হেরইতে উচকই লোচন তার ।।"

এমন অবস্থায় ঘরের বাহির হলে প্রাণসংশয়।কিন্তু প্রেমিকা রাধার সাধনাতো অসম্ভবেরই সাধনা।অসাধ্যকে সাধ্যয়ত্ত  করাই তার ভালোবাসার ব্রত।প্রেমের জন্য আত্মোৎসর্গ করতে তিনি ভীতা নন।হৃদয়ে এই প্রেম যখন একবার জেগেছে  তখন তাকে প্রতিরোধ করবে কে?
 চন্ডীদাসের অভিসারের পদটিও এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।সেই দুর্যোগে রাধা কেমন করে ঘরের বাইরে যাবেন? অথচ পরম দয়িতকে বৃষ্টিতে ভিজতে দেখে তার হৃদয় বিদীর্ণ হয়ে যায় :
             "এঘোর রজনী               মেঘের ঘটা
                           কেমনে আইল বাটে।
               আঙ্গিনার মাঝে           বঁধুয়া ভিজিছে
                           দেখিয়া পরান ফাটে।।"

ভক্ত যেমন ভগবানের জন্য ভগবানও তেমনি ভক্তের জন্য ব্যাকুল।এই চমৎকার অভিব্যক্তি পেয়েছে রবীন্দ্রনাথের নিম্নোক্ত কবিতাংশে :
"বাঞ্ছিতের আহ্বান আর অভিসারিকার চলা
 পদে পদে মিলিছে এক তানে
 তাই নদী চলেছে যাত্রার ছন্দে,
 সমুদ্র চলেছে আহবানের সুরে।"

অতএব অভিসারের কয়েকটি পদ পর্যালোচনা করে দেখা গেল মানবিক আঁধারে বিব্রত হলেও এই পর্যায়ের পদাবলীতে আমরা পরমাত্মার জন্য জীবাত্মার অভিসারের তাৎপর্যটি ক্ষণে ক্ষণে অনুভব করি।লৌকিক অভিসারের আবেদনে পদগুলী সমৃদ্ধ সন্দেহ নেই; তথাপি অধ্যাত্ম-আকুতি যে এই পর্যায়ের পদে প্রাধান্য লাভ করেছে সে বিষয়ে আমরা নিঃসংশয় হতে পারি।উপসংহারে তাই বলা যায় আলোচ্য অভিসারের পদ গুলি যাত্রা করেছে ভূমি থেকে ভূমার দিকে।



একথা সত্য যে, রাধার প্রেম ভূমির হয়েও ভূমার।কৃষ্ণ নাম শ্রবণে রাধার নিদারুণ আকুলতা স্মরণীয়।কৃষ্ণের নাম শুনেই তার মনের মধ্যে যে চিত্তচাঞ্চল্য জাগ্রত হয়েছে তা স্পষ্টতই অতিক্রম করে গেছে পার্থিবতার   সীমা। চন্ডীদাসের রাধা বলেন :

                          "সই কেবা শুনাইল শ্যামনাম
              কানের ভিতর দিয়া               মরমে পশিল গো 
                           আকুল করিল মোর প্রাণ।।"

 নায়কের নাম শ্রবণে নায়িকারএই চিত্তচাঞ্চল্য,
এই অধীর দর্শনাভিলাস কি মর্ত্য প্রেমে সম্ভব?রাধার নাম জপ কি ইস্টনাম জপের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করছে না? তথাপি একথা অনস্বীকার্য যে, রাধার প্রেম সর্বদা অমর্ত্যলোকের সামগ্রী নয়। প্রিয়তমাকে লাভ করার জন্য কুল, ভয়, লজ্জা পরিত্যাগ করে রাধার যে কঠোর কৃচ্ছ্রসাধনময় অভিসার,তা লৌকিক নায়িকার প্রেমও আমরা দেখেছি।প্রাকৃত কাব্য নায়িকা মহুয়া,মলুয়া চন্দ্রাবতীর প্রেমও তীব্রতা এবং গভীরতা এক এক সময় যেন রাধার প্রেমের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়।সর্বস্ব দিয়েও নায়িকা যখন নায়কের ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয় তখন  মানবী নায়িকাও যেন রাধার মতো বলে ওঠে : 

              "সুখেরও লাগিয়া            এ ঘর বাঁধিনু 
                          অনলে পুড়িয়া গেল।
            অমিয়া-সাগরে              সিনান করিতে
                         সকলি গরল ভেল।।"

পরিশেষে একথাই লিখছি যে বৈষ্ণব পদাবলী সম্পর্কে যত বলা যায় ততই মনে হয় যেন কম বলা হলো।বাস্তবিক বৈষ্ণব কবিতা যেন আমাদের মান-অভিমান,বিরহ,মিলন ভরা বাস্তব জীবনের সাহিত্যরূপ।বস্তুত বৈষ্ণ কবিতার প্রেম আমাদের কান্না হাসি বিজড়িত মর্থ প্রেমের বার বার স্মরণ করিয়ে দেয়।বৈষ্ণ পদাবলীর এই ধর্মাতিশায়ী উৎকর্ষের ভিত্তি আমাদের বেশি করে টানে এবং এদিক থেকে বৈষ্ণব কবিতাকে যথার্থই বিশুদ্ধ রোমান্টিক গীতি কবিতা বলে অভিহিত করা চলে।

অবশ্যই পড়ুন - ভগবান বিষ্ণুর দশ অবতারের কাহিনী

ধন্যবাদ  -

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ