শ্রীকৃষ্ণকীর্ত্তন কাব্যের নাট্যগুণ (The dramatic quality of Srikrishnakirtan poetry)


শ্রীকৃষ্ণকীর্ত্তন কাব্যের নাট্যগুণ (The dramatic quality of Srikrishnakirtan poetry)

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ

শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য বাংলা সাহিত্যের দ্বিতীয় গ্রন্থ এবং আদি মধ্যযুগের বাংলা ভাষার একমাত্র সাহিত্যিক নিদর্শন। পন্ডিত বসন্তরঞ্জন রায় দ্বিজবল্লভ ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে বাঁকুড়া জেলার কাঁকিল্যা গ্রামেরদেবেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের গোয়ালঘরের মাচা থেকে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের পুঁথিখানি আবিষ্কার করেন। পুঁথিখানি খন্ডিত অবস্থায় পাওয়া যায়। এর প্রথম, মধ্য ও শেষদিকের কয়েকটি  পৃষ্ঠা পাওয়া যায়নি। ফলে পুঁথিখানির আসল নাম কি ছিল তা জানা যায় নি। যেহেতু গ্রন্থটির বিষয়বস্ত কৃষ্ণের মাহাত্ম কীর্তন সেহেতু বসন্তরঞ্জন এর নামকরণ করেন 'শ্রীকৃষ্ণকীর্তন ' পুঁথিটির মধ্যে একটি চিরকুট পাওয়া যায় তাতে লেখা ছিল ' কৃষ্ণসন্দর্ভ '। সেইজন্য অনেকে  এই গ্রন্থকে 'কৃষ্ণসন্দর্ভ ' নামে অভিহিত করতে চান। তবে কৃষ্ণসন্দর্ভ নয়, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন নামেই গ্রন্থখানি ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছে। বসন্তরঞ্জনের সম্পাদনাতেই ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে প্রকাশিত হয় এবং প্রকাশিত হবার সঙ্গে সঙ্গে কবির নাম নিয়ে এক বিতর্কের সৃষ্টি হয়।


চন্ডিদাস সমস্যা -


পুঁথিটির প্রথম কয়েকটি পৃষ্ঠা না পাওয়া যাওয়ায় পুঁথিটির নাম, রচনাকাল ও কবির নাম নিয়ে নানা মতভেদের সৃষ্টি হয়েছে। কোন কোন পদের ভূমিকায় কবি নিজেকে বাসুলি দেবীর উপাসক হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন এবং নিজেকে 'বড়ু চন্ডীদাস' বলে উল্লেখ করেছেন। কোন কোন ভনিতায় 'অনন্ত চন্ডীদাস ' কোন কোন ভনিতায় শুধু 'চন্ডিদাস' নাম আছে।ফলে চন্ডীদাস নামটি নিয়ে গবেষক এবং পন্ডিত মহলে গবেষণার অন্ত নেই। কারও মতে কবির আসল নাম 'বড়ু চন্ডীদাস 'এবং অনন্ত' তার আরেকটি নাম। অনেকে মনে করেন বড়ু শব্দটি এসেছে বটু অর্থাৎ ব্রাহ্মণ শব্দ থেকে।সেই কারণে অনুমান করা যায় তিনি জাতিতে ছিলেন ব্রাহ্মণ এবং তিনি নিজেকে বাসুলি দেবীর পুজারি বলে বর্ণনা করেছেন।

"বাসলী চরণ শিরে বন্দিআ
 গাইল বড়ু চন্ডিদাস ।।"

 কিন্তু সমস্যা হয়েছে শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের বড়ু চন্ডীদাস এবং বৈষ্ণব পদাবলীর চন্ডীদাসকে 
ঘিরে। অনেকে বলেন দুই চন্ডীদাস একই ব্যক্তি। আবার অনেকে দুই চন্ডীদাসের ভাবাদর্শ,রুপির পার্থক্য দেখিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন উভয়ে আলাদা আলাদা ব্যক্তি। আজ পর্যন্ত এ বিষয়ে সর্ববাদীসম্মত সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সম্ভব হয়নি।

 রচনাকাল :
 পুঁথিটির রচনাকাল উল্লেখ না থাকায় পণ্ডিতেরা এর ভাষা ও লিপি বিচার করে এর কাল নির্ণয়ের চেষ্টা করেছেন। লিপি বিশারদ রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় মনে করেন পুঁথিটির রচনাকাল ১৩৫০ থেকে ১৪০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে হওয়াই স্বাভাবিক। ভাষাতাত্ত্বিক ডক্টর সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের অভিমত প্রকাশ করেছেন যে বইখানির ভাষা খঁটিয়ে আলোচনা করে আমার এই ধ্রুব বিশ্বাস দাঁড়িয়েছে যে এর ভাষা ১৪০০ থেকে বা ১৪৫০ খ্রিস্টাব্দের এধারে কিছুতেই হতে পারে না।নির্দিষ্টভাবে সন তারিখ জানা না গেলেও চৈতন্য প্রভাবিত বৈষ্ণব ভাবাদর্শ ও রুচির সঙ্গে এ কাব্যের কোন মিল না থাকায় কাব্যটি যে চৈতন্য পূর্ব যুগের রচনা সে কথা নিঃসন্দেহে বলা চলে।

 খন্ড বিন্যাস :  শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যটি ১৩ টি খন্ডে বিভক্ত।খন্ডগুলি যথাক্রমে -

  (১) জন্ম খন্ড (২)তাম্বুল খন্ড (৩) দান খন্ড (৪) নৌকা খন্ড (৫) ভার খন্ড (৬)ছত্র খন্ড (৭) বৃন্দাবন খন্ড (৮) কালীয়দমন (৯) যমুনা খন্ড (১০) হার খন্ড (১১) বাণমান (১২) বংশী খণ্ড (১৩) রাধা বিরহ।

কোন খন্ডে কতগুলী পদ রয়েছে -

জন্মখন্ডে - ৯ টি, তাম্বুল খন্ডে - ২৬ টি. দান খন্ডে - ১১২ টি. নৌকা খন্ডে - ৩০ টি  ভার খন্ডে - ২৮ টি  ছত্র খন্ডে - ৯ টি বৃন্দাবন খন্ডে - ৩০ টি কালীয়দমন খন্ডে - ১০ টি যমুনা খন্ডে - ২২ টি হার খন্ডে - ৫ টি বাণ খন্ডে ২৭ টি বংশী খন্ডে ৪১ টি রাধাবিরহে খন্ডে ৬৯ টি।

লক্ষ্য করায় বিষয় যে ' রাধাবিরহ, এর সঙ্গে খন্ড নাম যুক্ত নেই। ফলে এই অংশ বড়ুচন্ডী দাসের রচিত কিনা তা নিয়ে অনেকে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তাদের মতে যেহেতু অংশটি খন্ডনামাত্মক নয় সেহেতু এটি প্রক্ষিপ্ত অংশ।কিন্তু এমত মানা যায় না। কারণ বিষয়বস্তু ও ভাষা বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে রাধাবিরহ অংশটি গ্রন্থের অন্যান্য অংশের সঙ্গে যথেষ্ট সঙ্গতিপূর্ণ।

 কাহিনী বিচার  :

জন্মখন্ডে রাধা ও কৃষ্ণের জন্ম কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। কংসের অত্যাচার থেকে পৃথিবী কে রক্ষা করার জন্য বাসুদেব ও দেবকীর পুত্ররূপে ভগবান বিষ্ণু কৃষ্ণরূপে আবির্ভূত হন। অন্যদিকে সাগর ও পদুমার গৃহে রাধা নামে লক্ষীদেবী জন্মগ্রহণ করেন। যথাকালে আইহনের সঙ্গে রাধার শুভ পরিণয় হয়। বৃদ্ধা বড়াই হন রাধার সঙ্গিনী।

তাম্বুল খন্ডে দেখানো হয়েছে যৌবনবতী রাধা অন্যান্য গোপ নারীদের সঙ্গে প্রতিদিন মথুরা নগরীতে দধি দুগ্ধ বেচতে যায়। একদিন মথুরা যাওয়ার পথে রাধা কে দেখতে না পেয়ে বড়ায়ি গোচারণরত শ্রীকৃষ্ণের কাছে রাধার বর্ণনা দিয়ে খোঁজ খবর নেয়। রাধার রুপের বর্ণনা শুনে কৃষ্ণ তার প্রতি অনুরক্ত হয় এবং বড়য়ির হাত দিয়ে পান ফুলের মালা ও সন্দেশ প্রভৃতি উপহার পাঠায় এবং প্রেম নিবেদন করে।

দান খন্ডে  কৃষ্ণ দানী সেজে শ্রীরাধার পথ অবরোধ করে দাঁড়ায়।কর দিতে অসমর্থ হওয়ায় কৃষ্ণ তার দেহ এবং যৌবন দাবি করে। রাধা ও কৃষ্ণের মধ্যে তুমুল তর্ক-বিতর্ক হয়। শেষ পর্যন্ত রাধা অনিচ্ছায় কৃষ্ণের কাছে আত্মসমর্পণ করে।

অবশ্যই পড়ুন - গীতার প্রশ্ন ও উত্তর

 নৌকা খন্ডে কৃষ্ণ খেয়া ঘাটের মাঝি সেজে অন্যান্য গোপনারীদের এবং সেইসঙ্গে ছল করে বড়ায়িকে পরপারে পৌঁছে দেয়।একাকী রাধাকে নিয়ে মাঝ নদীতে গিয়ে ইচ্ছে করে নৌকা ডুবিয়ে দেয়। রাধা ভয় পেয়ে কৃষ্ণকে জড়িয়ে ধরে। তখন কৃষ্ণ রাধার সঙ্গে জলবিহারে মত্ত হয়।

ভার খন্ডে কৃষ্ণ ভারী হিসেবে উপস্থিত হয়েছে। রাধার ভার বহন করে কৃষ্ণ মঞ্জুরি  দাবি করেছে। রাধা বলেছে কৃষ্ণ স্বেচ্ছায় ভার বহন করেছে অতএব মঞ্জুরের কোন প্রশ্নই ওঠেনা। মথুরার উপকণ্ঠে এসে কৃষ্ণ রাধার আলিঙ্গন দাবি করল। রাধা প্রতিশ্রুতি দিল তাকে মথুরায় পৌঁছে দিলে তাকে আলিঙ্গন দেবে।

ছত্র খন্ডে দেখানো হয়েছে মিলনের প্রতিশ্রুতি প্রখর রৌদ্রে কষ্ট মোচন করার জন্য কৃষ্ণ রাধার মাথায় ছত্র ধারণ করেছে।

 বৃন্দাবন খন্ডে কৃষ্ণ এক মনোরম পুষ্প কুঞ্জ নির্মাণ করে রাধাকে আমন্ত্রণ করেছে এবং সেই কুঞ্জে উভয়ে মিলিত হয়েছে।

কালিয়দমন খণ্ড বর্ণিত হয়েছে কৃষ্ণ কর্ত্তক কালিয়ানাগ দমন এবং কৃষ্ণের জলকেলি, সেইসঙ্গে গোপীদের বস্ত্রহরণ।

হার খন্ডে রাধার হার চুরি এবং সেই কারণে মাতা যশোদা কর্ত্তক কৃষ্ণ কে ভর্ৎসনা।

বাণ খন্ডে অপমানিত কৃষ্ণ প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য বাণ মেরে রাধাকে মূর্ছিত করেছে। বড়াই কৃষ্ণকে নারী হত্যার অপরাধে অভিযুক্ত করলে কৃষ্ণ-রাধার চেতন ফিরিয়ে দেয়।

যমুনা খন্ডে  রাধা যমুনার ঘাটে স্নান করতে এলে নানা বাজনার মাধ্যমে তার মন আকর্ষণ করার চেষ্টা করে এবং ব্যর্থ হয়। তখন এক মধুর বংশীধ্বনির সাহায্যে রাধার মন প্রাণ কেড়ে নেয়। রাধা এবার হয়ে ওঠে কৃষ্ণ প্রেমে পাগলিনী। সাংসারিক কাজ কর্মে তখন আর মন নেই। কৃষ্ণের আগমন প্রত্যাশায় সারারাত দ্বারপ্রান্তে প্রতীক্ষা করে। কিন্তু কৃষ্ণ না আসায় রাধা বিরহ যন্ত্রনায় মূর্ছিত হয়। তখন বড়ায়ির সেবা-শুশ্রূষায় রাধা জ্ঞান ফিরে পায়।বড়ায়ির পরামর্শে রাধা কৃষ্ণের বাঁশি চুরি করে। তীব্র বাদানুবাদের পর রাধা কৃষ্ণের বাঁশি ফিরিয়ে দেয়।

রাধাবিরহ অংশে দেখানো হয়েছে রাধার অন্তহীন বিরহ। কৃষ্ণ প্রেমে পাগলিনী রাধা কৃষ্ণের সঙ্গে মিলনের জন্য উৎসুক কিন্তু কৃষ্ণ এখন উদাসীন। অবশেষে বড়ায়ির চেষ্টায় রাধা কৃষ্ণের মিলন ঘটে বৃন্দাবনে। নিদ্রারত রাধাকে ফেলে রেখে কৃষ্ণ চলে যায় মথুরায়। ঘুম থেকে জেগে উঠে কৃষ্ণকে দেখতে না পেয়ে রাধার অন্তর হাহাকারে ভরে ওঠে।এই সীমাহীন হাহাকার এর মধ্য দিয়েই গ্রন্থটির পরিসমাপ্তি ঘটেছে।


কাব্যমূল্য :

 প্রথমত : শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য বড়ু চণ্ডীদাসের কাব্য প্রতিভার সার্থক নিদর্শন। নাট্য রসামৃত গীতি কাব্যের সাথে আখ্যায়িকার মিশ্রণে অপূর্ব এক শিল্প সৃষ্টি করেছেন কবি। এই কাব্য প্রাকচৈতন্য যুগের বা আদি মধ্য-যুগের বাংলা ভাষায় রচিত একমাত্র আখ্যান কাব্য।

দ্বিতীয়তঃ শ্রীকৃষ্ণকাব্যে বাংলা নাটকের বীজ প্রোথিত আছে। রাধা,কৃষ্ণ,বড়াই এই তিন চরিত্রের উক্তি -প্রত্যুক্তির মধ্য দিয়ে দ্বন্দ্ব-সংঘাতময় নাটকীয় বৈশিষ্ট্য এই আখ্যান কাব্য কে করেছে নাট্য ধর্মী।

তৃতীয়ত : গীতি প্রাণতা এই আখ্যান কাব্যের আরেকটি বৈশিষ্ট্য। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের অনুসরণেই বাংলা সাহিত্যে পালা গানের উদ্ভব। প্রত্যেকটি পদে রাগরাগিণী ও তালের নির্দেশ আছে।

চতুর্থত : চরিত্র চিত্রণের দিক দিয়ে বড়ু চন্ডীদাস অপূর্ব কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। বিশেষ করে রাধা চরিত্রের ক্রমবিকাশ ও পরিণতিকে অপূর্ব দক্ষতায় সঙ্গে চিত্রিত করেছেন। রাধা বৈকুন্ঠের লক্ষী হলেও মর্ত্য জীবনে তিনি সাগরকন্যা এবং পদুমার কন্যা এবং আইহনের পত্নী। কৃষ্ণের প্রেমকে তিনি ঘেন্না ভরে প্রত্যাখ্যান করেছেন। সমাজের রীতিনীতি মেনে চলেন।জাতি - কুল - শীল - মানের ভয়ও তাকে পীড়িত করে। কৃষ্ণের আকর্ষণে রাধার বিরূপ মনোভাব ধীরে ধীরে অপসারিত হয়েছে এবং রাধা হয়ে উঠেছেন প্রেমময়ী। রাধা চরিত্রের এই ক্রমবিকাশ বড়ুর লেখনিতে হয়েছে সার্থক।

প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যে ' কুট্টিনী' চরিত্রের আদলে  বড়াই চরিত্রটি চিত্রিত। রাধা কৃষ্ণের প্রেমলীলা ও মিলন সাধনের কর্মে নিযুক্তা। তবে সে কেবল প্রেমলীলার দৌত্যকার্যের বিশ্বাসী নয়, সে কখনো প্রেমপ্রত্যাশী কৃষ্ণের সহযোগিনী, কখনো বিরহিনী রাধার অসীম দুঃখে সমব্যথিনী। বড়াই বড়ু চন্ডীদাসের অপূর্ব সৃষ্টি।
ভাষা প্রয়োগের ক্ষেত্রে চন্ডীদাসের নৈপুণ্য অপরিসীম। চর্যাপদে বাংলা ভাষার যে আড়ষ্টতা ছিল তা অতিক্রম করে কবি শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের ভাষাকে স্বাভাবিক শক্তির উৎস প্রতিষ্ঠা করেছেন।
ছন্দ ও অলংকারের ক্ষেত্রেও তিনি বৈচিত্র দেখিয়েছেন।সাত প্রকার পয়ারের প্রয়োগ তাঁর কাব্যে দেখা যায়। অলংকার প্রয়োগের ক্ষেত্রে তিনি যে দক্ষতা দেখিয়েছেন তা প্রশংসার যোগ্য। তার কয়েকটি অলংকারের  উদাহরণ নিচে দিলাম -

   ১. চুন বিহন যে / তাম্বুল তিতা
       অলপ বএসে তেহ্ন বিরহের চিতা।       

   ২. কেশপাশে শোভে তার সূরঙ্গ সিন্দুর
       সজল জলদ যেহ্ন উইল নব সুর।

শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে এমন কতকগুলি চরণ আছে যা পরবর্তীকালে প্রবাদে পরিণত হয়েছে।
যেমন -

১. ললাট লিখিত খন্ডন না জানএ 

২. দেখিয়া সাধুর ধান চোরে পুড়ি মরে।

৩.মাকরের হাতে যেন ঝুনা নারিকেল।

৪. দেখিল পাকিল বেল গাছের উপরে
    আরপিল কাক তাকে ভকিতে না পারে।

 একটি প্রচলিত গাথাকে অবলম্বন করে তার সাথে পুরাণ ভাগবত ও কৃষ্ণ কথা মিশিয়ে যে কাব্য তিনি রচনা করেছেন তাতে তাঁর পান্ডিত্য, কবিত্ব শক্তি ও মন্ডনকলার দক্ষতা স্বীকার করে নিতেই হয়। তাছাড়া রাধা বিরহে রাধার যে বিলাপ -

কে না বাঁশি বাএ বড়ায়ি কালিনী নই কূলে।
কে না বাঁশি বাএ বড়ায়ি এ গোঠ গোকুলে।।
আকুল শরীর মোর বেআকুল মন।
বাঁশির শবদে মো আউলাইলোঁ বন্ধন।।

তা বৈষ্ণব পদাবলীর আসন্ন আবির্ভাবের  সূচনা করেছে। সেই জন্য কোন কোন সমালোচক বলেছেন বড়ু চণ্ডীদাসের কাব্য যেখানে শেষ হয়েছে সেখান থেকেই বৈষ্ণব পদাবলীর যাত্রা শুরু হয়েছে।
এই কাব্যগ্রন্থে মোট ১৩ টি খন্ডে ৪১৮ টি পদে বিভক্ত। সংস্কৃত শ্লোক আছে মোট ১৬১ টি। শ্রীকৃষ্ণকীর্ত্তনের মূল কাহিনী ভাগবত থেকে নেওয়া হলেও এতে বিভিন্ন পুরাণ এবং কবি জয়দেবের লেখা গীতগোবিন্দের প্রভাব লক্ষিত হয়েছে।

এই কাব্যগ্রন্থে মোট ১৩ টি খন্ডে ৪১৮ টি পদে বিভক্ত। সংস্কৃত শ্লোক আছে মোট ১৬১ টি। শ্রীকৃষ্ণকীর্ত্তনের মূল কাহিনী ভাগবত থেকে নেওয়া হলেও এতে বিভিন্ন পুরাণ এবং কবি জয়দেবের লেখা গীতগোবিন্দের প্রভাব লক্ষিত হয়েছে।

এটি পয়ার ও ত্রিপদি ছন্দে রচিত।

শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে যে সব রাগ রাগিনীর উল্লেখ রয়েছে -
৩২ টি। যথা - পটমঞ্জরী, গুজ্জরী, ভৈরবী, ভাটিআলী, কেদার ইত্যাদি।

শ্রীকৃষ্ণ কীর্তনে রাধার বাবা মা, শ্বশুর- শাশ্বুড়ি - স্বামী  - ননদ - দেবর এর নাম -

বাবা - সাগর গোপ। মা - পদুমা বা পদ্মা। স্বামী  - আইহন বা আয়ান বা অভিমন্যু। শ্বশুর - গোল। শ্বাশুড়ি - জটিলা। ননদ - কুটিলা। দেবর - দুর্মদ।

শ্রীকৃষ্ণ কীর্তনে উল্লিখিত পাঁচবাণ হল -
১. স্তম্ভন ২. মোহন ৩. দহন ৪. শোষণ ৫.ঝ উচাটন।


শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে কৃষ্ণ অবতারের হেতু কী?

কাব্যে উল্লিখিত জন্মখন্ডে ব্যক্ত নারায়ণের কৃষ্ণ অবতারের হেতু অত্যাচারী রাজা কংসকে হত্যা করে পৃথিবীর ভার লাঘব করা তথা জগৎবাসীকে রক্ষা করা। কৃষ্ণ কালীয়নাগ দমন করে কালীদহের জলকে পান ও স্নানযোগ্য করে তোলে।

শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের সঙ্গে বৈষ্ণব পদাবলীর কী পার্থক্য?

বড়ু চন্ডীদাসের শ্রীকীর্তন আখ্যান কাব্য কিন্তু বৈষ্ণ পদাবলী ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পদ বিশেষ। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে রাধা কৃষ্ণ একান্ত ভাবে মানব মানবী কিন্তু পদাবলীর রাধা ও কৃষ্ণ জীবাত্ম ও পরমাত্মার প্রতীক। শ্রকৃষ্ণকীর্তনে আদিরসের উৎসার ঘটেছে কিন্তু পদাবলীতে বৈষ্ণবীয় পঞ্চরসের প্রকাশ আছে।


কীর্তন কথাটির অর্থ কী? কীর্তন কত প্রকার?


কীর্তন কথাটি অভিধানে পাওয়া যায়, যার অর্থ স্তুতি,প্রশংসা, যশোগাথা। কীর্তন এবং কীর্তিশব্দ একই উৎস। কেউ কেউ মনে করেন - 'কীর্তি লহরী' শব্দটি থেকে কীর্তন শব্দটি এসেছে। কীর্তি লহরী কথাটির অর্থ দেবতার বা বরেণ্য মহামানবের উদ্দেশ্যে কীর্তিগাথা বা যশোগান। তবে ভগবানের লীলা কীর্তন অর্থে কীর্তন শব্দটি ব্যবহার করা হয়। শ্রীমদ্ভাগবতে শ্রীকৃষ্ণের মহিমা গান প্রকাশের ক্ষেত্রে কীর্তন শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। শ্রী রূপ গোস্বামী তার
'ভক্তিরসামৃতসিন্ধু' গ্রন্থে কীর্তনের সংজ্ঞায় বলেছেন - "নাম লীলা গুনা দিলা তুচ্ছ ভাষা তু - কীর্ত্তনম।"বাংলা দেশে কীর্তনের  ইতিহাস শুরু হয়েছে চর্যাপদের সময় থেকে। জয়দেবের গীতগোবিন্দ চর্যাপদের রীতিতে লেখা। শ্রীচৈতন্যদেব কীর্তন গানের প্রসার  করেন, তিনি নৃত্য সহযোগে কীর্তন গান করতেন।

" দিশা দেখাইয়া প্রভু হাসে তালি দিইয়া ।
আপসে কীর্তন করে শিষ্যগণ লইয়া ।।"

পদাবলী কীর্তন পদ্ধতির প্রবর্তন করেছিলেন নরোত্তম দাস। জয়দেবের সময় থেকে পদাবলী গানের যে রীতি মিথিলায় ও বাংলায় প্রচলিত ছিল, তারই আধারে নরত্তম  ঠাকুর পদাবলী কীর্তনে ঠাট বেঁধে
দিয়েছিলেন।

কীর্তন তিন প্রকার (১)নাম কীর্তন (২) লীলা কীর্তন (৩) সূচক কীর্তন।

নাম কীর্তন হল সমবেতভাবে ভগবানের নাম ও গুনগান করা।প্রাক-চৈতন্য যুগে সংকীর্তন করার রীতি চৈতন্যদেবের সময় থেকে প্রচলিত ছিল। চৈতন্য পরিকরদের অনেকেই ছিলেন কীর্তনে নিপুন। নাম কীর্তন চিত্ত শুদ্ধি ঘটায়।

লীলা কীর্তনকে পালা কীর্তনও বলে।রাধা- কৃষ্ণের লীলা অবলম্বনে কোন একটি পর্যায়ের পদ পালা ধদ্ধ করে গাওয়া হয়। বিভিন্ন মহাজনের উৎকৃষ্ট পদ একত্রিত করে কীর্তনীয়া গান করে থাকেন। চৈতন্যদেবের সময় থেকে লীলা কীর্তনের প্রচলন। খেতুরির মহোৎসবে নরোত্তম দাস ঠাকুর  পালা কীর্তনকে নতুন রূপ দিয়েছিলেন।

 সূচক কীর্তন গাওয়া হয় কোন প্রসিদ্ধ বৈষ্ণব ভক্ত ও মহাজনের তিরোভাব উৎসবে।বৈষ্ণব ধর্মে নাম কীর্তন ও লীলা কীর্তন বেশি গুরুত্ব পেয়েছে।

আমার প্রিয় পাঠকগণ এই লেখাটি পড়ে যদি ভালো লাগে তবে মতামত জানিয়ে আমাকে অনুপ্রেরনা দেবেন। এরপরের  লেখাতে বৈষ্ণব পদাবলী বিষয়ে কিছু কথা আপনাদের সামনে পরিবেশন করবো।
সবাই ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন এই কামনা করি।

ধন্যবাদ-

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ