ভগবান বিষ্ণুর দশ অবতার-দশাবতারঃ তত্ত্ব


ভগবান বিষ্ণুর দশ অবতার-দশাবতারঃ তত্ত্ব

এই মহা বিশ্বব্রহ্মান্ডের পালনকারী ভগবান শ্রী বিষ্ণু বিশ্বব্রহ্মান্ডকে রক্ষা করার জন্য প্রতিটি যুগে বিভিন্ন রূপে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়েছেন। তাই আমি এখানে  ভগবান বিষ্ণুর দশ অবতারের কাহিনি  বর্ণনা করলাম যাকে দশাবতারও বলা হয়।


অবতার কাকে বলে? অবতার কয় প্রকার?

অবতার   -  হিন্দু ধর্মে অবতার শব্দের আক্ষরিক অর্থ হলো অবতরণকারী অর্থাৎ কোন বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য স্বেচ্ছায় মর্ত্যে অবতীর্ণ পরম সত্ত্বাকে বোঝায়। 

এইসব অবতার গুলি সর্বজনশ্রদ্ধেয় ও অতিলৌকিক ক্ষমতা সম্পন্ন। হিন্দু ধর্মে অন্যান্য অবতারের তুলনায় ভগবান বিষ্ণুর দশ অবতার সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ।


ভগবান বিষ্ণুর দশ অবতার কি কি? কেন তারা এই পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়েছিলেন?


দশাবতারঃ তত্ত্বঃ- উপরে উল্লিখিত এই যে অবতারতত্ত্ব তার মূলে রয়েছে প্রধানত হিন্দুদের নানারকম ধর্মীয় বিশ্বাস ও ভক্তি। হিন্দুদের ধর্ম, সমাজ ও সংস্কৃতিতে এর প্রভাব অত্যন্ত গভীর। তবে দশ অবতারের মধ্যে রাম ও কৃষ্ণের প্রভাবই সবচেয়ে বেশি । হিন্দুদের ধ্যানে-জ্ঞানে, এমনকি দৈনন্দিন জীবনেও এই দুই অবতারের প্রভাব লক্ষণীয়। এমনকি কোথাও কোথাও হিন্দুদের সামাজিক উৎসবেরও প্রধান অঙ্গ হিসাবেও দেখা যায় ভগবান বিষ্ণুর এই দশাবতার। 


অবতার ছয় প্রকার - ১. পুরুষাবতারঃ ২. গুনাবতারঃ ৩. মন্বন্তরাবতারঃ ৪. যুগাবতারঃ ৫. লীলাবতারঃ ৬. শক্ত্যাবেশ অবতারঃ।


আমরা যে ভগবান বিষ্ণুর দশ অবতারের কথা বর্ণনা করবো তা ভগবানের লীলাবতারের পর্যায়ের মধ্যে পড়ে।এখানে আমরা ভগবান বিষ্ণুর প্রধান ১০টি অবতারের নাম ও তাদের কাহিনী বর্ণনা করলাম।


ভগবান বিষ্ণুর দশাবতার
বিষ্ণুর দশ অবতার


ভগবান শ্রী বিষ্ণুর দশ অবতারের  নাম  -

১. মৎস্য ২. কুর্মো ৩. বরাহ ৪. নৃসিংহ ৫. বামান ৬. পরশুরাম ৭. রাম ৮. বলরাম ৯. বুদ্ধ ১০. কল্কি।


মৎস্য অবতার

ভববান বিষ্ণুর দশ অবতারের মধ্যে প্রথম অবতার হল মৎস অবতার।অতীত কল্পের অবসান প্রায় আসন্ন। পদ্মযোনী ব্রহ্মার তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থা, তিনি চোখদুটি খুলতে পারছেন না। নিদ্রামগ্ন হলেন। তার নাক ডাকার আওয়াজ থেকে সৃষ্টি হল হয়গ্রীবা নামক এক অসুর।নিদ্রাকালে তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল বহু উপদেশাবলী।যা পরে বেদ নামে খ্যাত।হয়গ্রীব নামে সেই অসুর সেইসব বেদ বাক্য শ্রবণ করে সেখান থেকে চলে গেলেন।

এ তথ্য ভগবান শ্রীহরির কাছে অজানা রইল না।যেমন করেই হোক সেইসব বেদরাজি উদ্ধার করতে হবে। তাই শ্রীহরি একটি ক্ষুদ্র মৎস রূপ ধারন করলেন।এমন সময় সত্যযুগের প্রারম্ভে সত্যব্রত নামে এক বিখ্যাত রাজা ছিলেন।  রাজা সত্যব্রত অত্যন্ত ক্ষমাশীল, সর্বোগুণে সমৃদ্ধ এবং একজন সাহসী রাজা ছিলেন।

পুত্রের হাতে রাজ্য হস্তান্তর করে তিনি নিজে তপস্যা করতে বনে যান।  একদিন রাজা সত্যব্রত নদীতে  তর্পণ করতে গিয়েছিলেন।এবং তর্পন করার জন্য যখন অঞ্জলী পেতে নদীর স্বচ্ছ জল ধারন করতে যাবেন ঠিক তখনই  একটি ছোট মাছ তার অঞ্জলী পুটে উঠে এল। রাজা সত্যব্রত তখন মাছটিকে নদীতে ফেলে দিলেন। মাছটি তখন পরম মমতায় রাজাকে বলল-

"রাজন!  আমাকে রক্ষা কর  তুমি তো জানো যে জলে থাকা বড় প্রাণীরা ছোট মাছ গুলোকে খেয়ে ফেলে, তাহলে আমাকে এই জলে ফেলে দিচ্ছ কেন?  

রাজা সত্যব্রত সেই মাছটির অত্যন্ত বিনীত আবেদন শুনে তা নিজের কমণ্ডলুর মধ্যে রেখে আশ্রমে নিয়ে আসেন।  এক রাত্রিতে সেই মাছ এত বেড়ে গেল যে কমণ্ডলুতে আর থাকার জায়গা রইল না।

তখন সে রাজাকে বলল- “রাজন!  এখন আমি কমন্ডলুতে থাকতে পারব না, তাই আমার জন্য কিছু বড় জায়গা ঠিক করুন।  ,

তারপর রাজা সত্যব্রত সেই মাছটিকে কমণ্ডলু থেকে বের করে একটি বড় জলের পাত্রে রাখলেন।  কিন্তু দুই ঘণ্টার মধ্যে সেও তিন হাত বেড়ে গেল।

তখন মাছটি রাজাকে বললেন- “রাজন!  এমনকি এই পাত্রটিও এখন আমার জন্য যথেষ্ট নয়, তাই আমাকে ভালোভাবে  থাকার জন্য অন্য কোনও বড় জায়গা দিন। 

রাজা সত্যব্রত সেই মাছটি সেখান থেকে তুলে নিয়ে একটি বড় হ্রদে রেখেছিলেন, কিন্তু কিছুক্ষনের মধ্যেই সেই মাছটি সেই হ্রদের জলেও বিশাল আকার চেহারা নিল।  তারপর রাজা তাকে হ্রদ থেকে তুলে সমুদ্রে নিক্ষেপ করার জন্য সমুদ্রের দিকে গমন করবেন এমন সময় মাছটি আঁতকে উঠলেন।এবং মাছটি বললেন- “রাজন!  সমুদ্রে অনেক দৈত্যাকার প্রাণী বাস করে, তারা আমাকে গিলে ফেলবে, তাই আমাকে সমুদ্রে ফেলবেন না।  

এই কথা শুনে রাজা সত্যব্রতের মনে সন্দেহ হল - এ মাছ কোন সাধারণ মাছ নয়।তাই রাজা মাছটিকে জিজ্ঞেস করলো- “ সত্যি করে বলো কে আপনি? আপনার আসল পরিচয় দিয়ে আমার বিভ্রান্তি দূর করুন।

আপনি কয়েক দিনে আপনার আকার দিয়ে একটি বিশাল হ্রদকে ঢেকে ফেলেছেন।  এমন শক্তিশালী প্রাণী আমি কখনো দেখিনি বা শুনিনি।

নিশ্চয়ই আপনি সর্বশক্তিমান শ্রীহরি।  হে শ্রেষ্ঠ মানব, তোমাকে নমস্কার।  দয়া করে বলবেন কি উদ্দেশ্যে এই মাছের রূপ ধরেছেন?  ,

রাজার এমন কথা শুনে মৎস্যরূপী ভগবান শ্রীহরি বললেন- “রাজর্ষী আজ থেকে ছয় দিন পর অর্থাৎ সপ্তম দিনে সমুদ্রে এক প্রকান্ড প্রলয় শুরু হবে এবং সেই প্রলয়ে  ত্রিলোক অর্থাৎ স্বর্গ,মর্ত্য, পাতাল সব সাগরে ডুবে যাবে।

সেই সময়  একটি বিশাল নৌকা তোমার কাছে আসবে।সেটা আমিই পাঠাবো।

তখন তুমি সমস্ত ওষুধ, সকল প্রকার বীজ,  সপ্তঋষিগণ, বাসুকি নাগকে সঙ্গে নিয়ে সেই বৃহৎ নৌকায় উঠে বসবেন।

তখন পৃথিবীতে আলো থাকবে না।সব অন্ধকারে ডুবে যাবে। শুধু ঋষিদের ঐশ্বরিক তেজই হবে আলো। ঝড়ের প্রচণ্ড বেগে যখন নৌকা টলমল করবে তখন আমি এক শৃঙ্গরূপী মৎস হয়ে জলে ভেসে থাকব।তখন তুমি বাসুকি নাগের একদিক আমার শিংয়ে বেঁধে দেবে আর অন্যদিকটা নৌকার সঙ্গে বেঁধে দেবে। দেখবে তখন নৌকা স্থির হয়ে যাবে। 

সেই সময়, যখন আপনি আমায় যা  প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করবেন, আমি তাদের উত্তর দেব, যা থেকে আমার মহিমা আপনার হৃদয়ে প্রস্ফুটিত হবে।  এই বলে মৎস্যরূপী ভগবান শ্রীহরি স্বচ্ছ জলে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।


রাজর্ষি সত্যব্রত ভগবানের কথামত সেই সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন।  বিপর্যয়ের সময় ঘনিয়ে এলে সত্যব্রত তাঁর আশ্রমের কাছে আসন বিছিয়ে ভগবান শ্রী হরির ধ্যানে মগ্ন হলেন।

তখনই রাজা দেখলেন যে সাগরে প্রচন্ড প্রলয়ে শুরু হয়েছে। এক একটা প্রকান্ড ঢেউ আছড়ে পড়ছে পৃথিবীর বুকে।সীমানা ভেঙ্গে চারদিক থেকে পৃথিবীকে ডুবিয়ে দিচ্ছে এবং সেই সাথে কালো মেঘে সারা আকাশ ঢেকে যাচ্ছে এবং প্রচন্ড বৃষ্টি শুরু হয়েছে।

তখন তিনি ঈশ্বরের আদেশে ধ্যান করলেন এবং তখনই দেখলেন কোথা থেকে একটা বড় নৌকা এসে তাদের সামনে থামল।  তারপর রাজা ওষুধ, বীজ এবং জীবের সূক্ষ্ম দেহ নিয়ে সপ্তঋষিদের সাথে সেই নৌকায় উঠলেন।

 তখন সপ্তর্ষিগণ প্রসন্ন হয়ে বললেন- “রাজন! শ্রহরি স্মরণ নাও তিনিই আমাদের এই সংকট থেকে রক্ষা করবেন।  ,

এরপর রাজা ধ্যান করার সাথে সাথে শ্রী হরি মাছের রূপ ধারণ করে সেই প্রলয়ের জলে আবির্ভূত হলেন।  তাঁর শরীর ছিল সোনার মতো উজ্জ্বল এবং অত্যন্ত বিশাল।  তার একটি শিংও ছিল।

রাজা তখন বাসুকির সাহায্যে ভগবান মৎস্যের শিংয়ে সেই নৌকাটি বেঁধে দিলেন এবং প্রসন্ন হয়ে নিজেই ভগবানের প্রশংসা করতে লাগলেন।

রাজা সত্যব্রতের স্তবে সন্তুষ্ট হলে শ্রীহরি। সেইসময় তিনি জলে ভাসমান অবস্থায় রাজাকে অনেক তত্ত্বকথা শোনালেন। এই সব তত্ত্ব- উপদেশ নিয়েই লেখা হয়েছে মৎস পুরাণ।

বিপর্যয়ের শেষে ভগবান শ্রীহরি হয়গ্রীব নামে অসুরকে বধ করে তার কাছ থেকে বেদ ছিনিয়ে নিয়ে ব্রহ্মাকে দিয়েছিলেন।

ভগবানে শ্রীহরির কৃপায় রাজা সত্যব্রত এই কল্পে বৈবশ্বত মনু হয়েছিলেন।


কূর্ম অবতার


ভববান বিষ্ণুর দশ অবতারের মধ্যে দ্বিতীয় অবতার হল কূর্ম অবতার।একদা স্বর্গলোকের নন্দনকাননের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন মুনিবর দুর্বাসা।হঠাৎশুনতে পেলেন ঘন্টাও শঙ্খের আওয়াজ সেই আওয়াজ শুনে ছুটে গেলেন সেইদিকে।সেসময় ঊর্বশী শ্রীবিষ্ণুর পূজায় ব্যস্ত ছিলেন। দুর্বাসা মুনি কে অতিথি রূপে গ্রহণ করে উর্বশী পরম আদরে তার পূজা করলো।এবং ঊর্বশী গতরাতে ইন্দ্রের নিকট হতে একটি পারিজাতের মালা উপহার পেয়েছিল। ঊর্বশী সেই বাসি পারিজাতের মালা দিয়ে মুনির পুজো শেষ করলেন।

 মুনিবর দূর্বাশা এবার ইন্দ্রর নিকট চললেন। পথে দেখা হয়ে গেল ইন্দ্রের সাথে। দেবরাজ ইন্দ্র তখন ঐরাবতে চড়ে ভ্রমন করছিলেন।তখন মুনি দূর্বাশা নিজের গলা থেকে মালাটি খুলে ইন্দ্রের গলায় পরিয়ে দিলেন। দেবরাজ ইন্দ্রের  চিনতে মোটেই অসুবিধা হল না যে এই সেই পারিজাতের মালা যা গতকাল তিনি উর্বশীকে দিয়েছিলেন।তার মানে ঋষি দূর্বাশাও উর্বশীকে ভালোবাসে।ইন্দ্রদেব মনে মনে অত্যন্ত রুষ্ট হলেন।তখন তিনি  গলা থেকে সেই মালাটি খুলে ঐরাবতের মাথায় রেখে দিলেন। ঐরাবত সেই মালাটি মাটিতে ফেলে পা দিয়ে থেঁতলে দিল।

ঋষির দেওয়া আশীর্বাদ স্বরূপ উপহার অবজ্ঞা করে ফেলা দেওয়ায় দুর্বাসা মুনি ইন্দ্রের উপর রুষ্ট হয়ে তাকে শাপ দিলেন যে, তুমি শ্রীভ্রষ্ট হবে।

কূর্ম অবতার


ইন্দ্র শ্রীভ্রষ্ট হলে সুযোগ পেয়ে অসুরগণ দেবতাদের সবকিছু কেড়ে নিয়ে স্বর্গচ্যুত করল। স্বর্গচ্যুত হয়ে দেবতারা সদলবলে পদ্মযোনি ব্রহ্মা কাছে এসে উপস্থিত হলেন। ব্রম্ভ তাদের সকলকে নিয়ে গেলন শিবের কাছে। শিব এবং ব্রহ্মা অন্যান্য দেবতাদের সঙ্গে নিয়ে হাজির হলেন ক্ষিরোদ সাগরের তীরে শ্বেতদ্বীপে।সেখানে সকলে মিলে শ্রীভগবানের স্তব শুরু করলেন

এতে দেবতাদের প্রতি খুশী হয়ে শ্রী হরি সেখানে এসে স্বয়ং আবির্ভূত হলেন। শ্রী হরি বললেন-হে দেবতাগণ,শুক্রাচার্যের পরামর্শ দ্বারা দানব দৈত্য যতদিন পরিচালিত হবে ততদিন তোমাদের অপেক্ষা করতে হবে।  তাই বলছি তোমরা ঐ সব অসুরদের সাথে সন্ধি করো এতে তোমাদের মঙ্গল হবে।

এখন আমি যা বলছি মন দিয়ে শোনো।ঐ ক্ষীর  সমুদ্রে সমস্ত রকম ঔষধি নিক্ষেপ করো তাতে অমৃত সৃষ্টি হবে।সেই অমৃত পান করে তোমারা বলশালী হবে তখন অসুরগণকে তোমারা পরাজিত করতে পারবে। এই বলে শ্রী হরির সেখান থেকে প্রস্থান করলেন। এরপর সমস্ত দেবতারা এলেন অসুররাজ বলির কাছে। শ্রী বিষ্ণুর উপদেশ সম্পর্কে জানতে পেরে অসুরেরা অমৃত পানের লোভে দেবতাদের সঙ্গে হাত মেলাল।

এবার শুরু হল সমুদ্রমন্থনের কাজ বহুকষ্টে দেব ও অসুরগণ এর সাহায্যে মন্দার পর্বত কে উত্তোলিত করা হলো কিন্তু ক্ষীরোদ সাগর নিয়ে যাওয়া সম্ভব হলো না। তখন স্বয়ং শ্রী হরি  হাত লাগালেন। এক হাতে তিনি মন্দার পর্বত কে তুলে ধরে গরুড়ের পিঠে চাপিয়ে দিলেন।গরুড় অনায়াসে এই পাহাড় কে এনে স্থাপন করল ক্ষীরোদ সাগরের  বুকে। এরপর সর্পরাজ বাসুকিকে পর্বতের  চারপাশে ঘিরে বেঁধে ফেলা হলো। অসুরেরা এক প্রান্ত আর দেবগন অন্য প্রান্ত ধরে সমুদ্রমন্থন করতে শুরু করলেন কিন্তু দেখা গেল মহা বিপত্তি।গুরুভারে মন্দার পর্বত সমুদ্রের তলায় ঢুকে যেতে শুরু করল। সবাই তখন ম্লান বদনে ভাবতে লাগলো কি করা যায়? আবার সবাই শ্রী হরির স্মরণ নিলেন।তখন শ্রী হরি একটি কূর্মের রূপ ধারণ করে সমুদ্রের তলদেশে গিয়ে মন্দার পর্বতকে পৃষ্ঠদেশে তুলে ধরলেন।আবার শুরু হলো মন্থনের কাজ।

প্রথমে উঠল তীব্র হলাহল বিষে। যে বিষের জ্বালায় ত্রিভুবনের সমস্ত প্রাণী বিনষ্ট হবে।তখন সবাই অতিশয় ভীত হয়ে শিবের স্মরণ নিলেন। স্বয়ং শিব সেই হলাহল পান করে জগতকে বিষমুক্ত করলেন।নিজে হলেন মৃত্যুঞ্জয়।আর কন্ঠে ধারণ করে নাম নিলেন নীলকন্ঠ।

বিষের বিনাশ হল। আবার মহোল্লাসে মন্থনের কাজ শুরু করলেন এবার উঠে এলো এক গাভী নাম সুরভি। যজ্ঞাদির প্রয়োজনে  পবিত্র ঘৃতের জন্য ঋষিকুল সেই গাভী গ্রহণ করলেন। এবার উঠে এলো শ্বেতবর্ণ এক অশ্ব। 

দৈত্যরাজ বলি তাকে সাদরে নিয়ে এলেন।তারপর পাওয়া গেল এক ঐরাবত নামক হস্তি। সেটি নিলেন ইন্দ্র।ভগবান শ্রীহরি পদ্মরাগমণিটি বক্ষে ধারণ করার অভিলাষে সেটি গ্রহণ করলেন। পাওয়া গেল এক কল্পবৃক্ষ নাম পারিজাত। এবার সমুদ্র মন্থন করে উঠে এলেন মহাদেবী লক্ষ্মী। সেই দেবীর সেবায় সবাই রত হলেন কিন্তু লক্ষীদেবী কারো কাছে গেলেন না। সদয় হলেন শ্রী হরির প্রতি। এবং তাকে স্বামী রুপে গ্রহণ করলেন।

 এবার মন্থন করে পাওয়া গেল সুরা। অসুরগণ তা পান করে মহা তৃপ্তি পেলেন। তারপর উঠে এলো এক পুরুষ,অপূর্ব তার দেহ বল্লরী,অলঙ্কারে ভূষিত,হাতে তার কলস অমৃত ভান্ডার। যার জন্য দেবতা ও অসুরেরা মন্থন করেছিল। এবার সেই আশা তাদের পূর্ণ হল হতে চলেছে।কাড়াকাড়ি পড়ে গেলঅমৃত পান করার আশায়।কিন্তু দেবতারা পারবে কেন অসুরদের সাথে?চারিদিকে বিশৃঙ্খলা দেখে দিল।দেবতারা মুখ ভার করে বিষ্ণুর কাছে হাজির হলেন। তখন শ্রী বিষ্ণু এক অপরূপা নারী মূর্তি ধারণ করলেন। তাকে দেখে অসুরদের মনে কামনা জাগল তারা ওই সুন্দরী পরিচয় জানতে চাইল এবং সেই অপরূপ রমনীকে অনুরোধ করল অমৃত বন্টন করার জন্য।   নির্দ্বিধায় ওই নারীর হাতে অমৃত ভান্ডার তুলে দিলো।নারীরূপী ভগবান  বললেন আমি যা করব তা যদি তোমরা মেনে নাও তাহলে এই অমৃত আমি ভাগ করে তোমাদের দিতে পারি। তখনও পর্যন্ত কেউ জানে না যে এই রমনীটি আসলে কে?তারা বলল বেশ তোমার কথায় আমরা মেনে নিলাম। তারপর সেই মোহিনী দেবতা ও অসুরদের আলাদা আলাদা সারিতে বসতে বললেন।রমনী তখন বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি ও ছলাকলা করে দেবতাদের সেই অমৃত দান করলেন।আর ওদিকে অসুরেরা তখন সেই অমৃত থেকে বঞ্চিত হল।দানবেরা তাদের মুখে কিছু বলল না কিন্তু রাহু  নামে এক অসুর রমনীর সেই মতলব বুঝতে পারল।বুঝতে পেরে ঢুকে পড়ল দেবতাদের আসনে। দেবতাদের সারিতে  সূর্যও চন্দ্রের মাঝে একটু জায়গায়  বসে পড়ল। মোহিনী মূর্তি তাকেও সেই অমৃত দান করল।শ্রীহরি সব বুঝতে পারলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে সুদর্শন চক্র দিয়ে বাহুর মস্তক ছিন্ন করলেন। 

এইভাবে দেতারা অমৃত লাভ করলেন এবং দানবদেরকে পরাজিত করে আবার স্বর্গ পুনরোদ্ধার করলেন।


 বরাহ অবতার


ভববান বিষ্ণুর দশ অবতারের মধ্যে তৃতীয় অবতার হল বরাহ অবতার।পুরানের মতে ভগবান বিষ্ণু হীরণ্যাক্ষ নামক রাক্ষসের হাত থেকে ভূদেবী পৃথিবী কে উদ্ধার করেন। বরাহ অবতারে চারটি হাত। চার হাতে শঙ্খ,চক্র, গদা ও পদ্ম এবং বরাহদন্তে পৃথিবীকে ধরে থাকে। 


অমৃত পান করার পর দেবতারা অসুরকূলকে হত্যা করেছিল। এতে কশ্যপ পত্নি দিতির মনে খুব কষ্ট হয়েছিল।তাই মনে ভাবল আমার যদি দুটি বলশালী পুত্রসন্তান থাকতো যারা দেবতাদের পরাজিত করতে পারবে।


তাই একদিন সূর্যাস্তের সময় স্বামী কশ্যপ যখন সান্ধ্যপূজায় মগ্ন ছিলেন, ঠিক সেই সময়ে তাঁর স্ত্রী  দিতি কামাপীড়িতা হয়ে তাঁর কাছে পৌঁছে সন্তান লাভের ইচ্ছা প্রকাশ করেন।


মহর্ষি কাশ্যপ বললেন না।এখন রতি ক্রিয়ার সময় নয়। এখন আমি তোমার মনের কামনা পূর্ণ করতে পারবো না। কিন্তু দিতির জেদের সামনে তিনি পরাজিত হলেন।এবং ঋষি কশ্যপের বীর্জ স্খলনের ফলে দিতি গর্ভে সন্তান ধারন করলেন।

পরে মহর্ষি কাশ্যপ দিতি দেবীকে বললেন – “তুমি চারগুণ অপরাধ করেছ।  একটা হলো তোমার লালসার কারণ, তোমার মন নোংরা, দ্বিতীয়ত ঘোর অসময়ে তুমি কাজটা করলে, তৃতীয়ত তুমি আমার আদেশ অমান্য করেছ, আর চতুর্থ তুমি রুদ্র প্রভৃতি দেবতাদের অসম্মান করেছ।  এই কারণে, তোমার গর্ভ থেকে দুটি সন্তান আসবে তারা অত্যন্ত নিষ্ঠুর হবে।  তাদের অপকর্ম ও নৃশংসতার কারণে দেবতারা ক্রুদ্ধ হবেন এবং সারা পৃথিবী বিপর্যস্ত হবে।


তারা এতই পরাক্রমশালী ও নিষ্ঠুর হবেন যে নারায়ণ নিজেই তাদেরকে হত্যা করার জন্য দুটি ভিন্ন অবতার গ্রহণ করবেন।  


বিষ্ণুর দশ অবতার
বরাহ অবতার


যথাসময়ে দিতি দুটি যমজ সন্তানের জন্ম দিলেন।  সেই সন্তানরা পৃথিবীতে পা রাখার সাথে সাথেই পৃথিবী, আকাশ ও স্বর্গে নানা অশান্তি দেখা দিতে থাকল।দুই ভাই জন্মের সাথে সাথে পরম পরাক্রমশালী হয়ে ওঠে।  

বাল্যকাল থেকেই তারা যুদ্ধ বিদ্যায় পারদর্শী।নির্দোষ প্রাণীদের নির্দয়ভাবে হত্যা করতেন। এবং স্বর্গাধিপতি ইন্দ্রদেবকে পরাজিত করার ইচ্ছা পোষণ করেন।তাই গুরু শুক্রাচার্যের পরামর্শে হীরণ্যাক্ষ ভগবান ব্রহ্মার ঘোরতর তপস্যা শুরু করলেন। কঠোর তপস্যায় ভগবান ব্রহ্মা সন্তুষ্ট হলেন। এবং তাকে ইচ্ছা মতো বর চাইতে বললেন।তখন হীরণ্যাক্ষ এই বর চাইলেন যে - কোন রক্ষ-যক্ষ,দেব-দানব,মনুষ্য-কিন্নর, পশু-পাখির দারা যেন তার মৃত্যু না হয়। ব্রহ্মা বর দান করলেন। বর পেয়ে হীরণ্যাক্ষ প্রবল অহংকারী ও অত্যাচারী হয়ে ওঠে।সে দেবতাদের পরাজিত করে স্বর্গরাজ্যে  দখল করে নেয়। 

একবার হিরণ্যাক্ষ ভাবলেন- 'পৃথিবীতে বসবাসকারী সকল নারী পুরুষেরা দেবতাদের যজ্ঞ ও পূজা ইত্যাদি করবেন, এতে দেবতাদের শক্তি আরও বৃদ্ধি পাবে।  

এই ভেবে তিনি পৃথিবীকে পাতাল গহ্বরে নিয়ে গিয়ে লুকিয়ে রাখলেন। 

 

বিতাড়িত দেবগন এবং স্বংয় ব্রহ্মা শ্রীহরি বিষ্ণুর শরণাপন্ন হন। ভগবান বিষ্ণুর কাছে আকুল প্রার্থনা করেন যেন তিনি এই সংকট থেকে তাদেরকে রক্ষা করেন।   


ভগবান বিষ্ণুর তখন একটি বরাহ বা শূকর  অবতারের রূপ ধারণ করেন।কারন হীরণ্যাক্ষ সব পশুর নাম বললেও বরাহ বা শূকরের নাম করতে ভুলে গিয়েছিল। আর তাই ভগবান বিষ্ণু বরাহ অবতার ধারন করলেন পৃথিবীকে রক্ষা করার জন্য।  দুটি বড় দাঁত দিয়ে ভগবান ভূমি দেবীকে ধারণ করে জলের উপর তুলে ধরেন।  ভগবান গদাযুদ্ধে হীরণ্যাক্ষকে পরাজিত করে। এবং সামনের তীক্ষ্ন দাঁত  আঘাত করে হীরণ্যাক্ষকে বধ করে। দেবতারা পুনরায় স্বর্গ রাজ্য ফিরে পেল।


নৃসিংহ অবতার


ভববান বিষ্ণুর দশ অবতারের মধ্যে চতুর্থ অবতার হল নৃসিংহ অবতার।দেবতারা হিরণ্যাক্ষকে হত্যা করার পর  হিরণ্যকশিপু দেবতাদের উপর প্রচন্ড ক্ষুব্ধ হল। এবং তার অন্তরে প্রতিশোধের আগুনে জ্বলতে থাকলো।তাই সে  মহেন্দ্রচল পর্বতে গেল ব্রহ্মার তপস্যা করার জন্য যাতে ব্রহ্মার কাছ থেকে অমরত্ব বর লাভ করা যায়। পর্বতে সে ব্রহ্মার কঠোর তপস্যা শুরু করল।

এখন হিরণ্যকশিপুকে তপস্যায় মগ্ন দেখে দেবরাজ ইন্দ্র অসুরদের আক্রমণ করেন।  অসুররা  যুদ্ধে পরাজিত হয়ে পলায়ন করে গুহায় আশ্রয় নেয়।

ইন্দ্র প্রথমে প্রাসাদে প্রবেশ করে হিরণ্যকশিপুর স্ত্রী কায়ধুকে বন্দী করে নিয়ে যান।  তখন তিনি গর্ভবতী ছিলেন, তাই ইন্দ্র তাকে সঙ্গে নিয়ে অমরাবতীর দিকে যেতে লাগলেন।পথে হঠাৎ  নারদের সাথে দেখা হয়।  নারদজী বললেন- “দেবরাজ, ইনাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?  ,

ইন্দ্র বললেন-  হে নারদ কায়ধুর গর্ভে হিরণ্যকশিপুর সন্তান আছে।আমি তাকে হত্যা করবো। এই কথা শুনে নারদজী বললেন- “দেবরাজ!  এর গর্ভে ভগবানের এক মহান ভক্ত আছে, যাকে হত্যা করা তোমার ক্ষমতার বাইরে, তাই একে ছেড়ে দাও। নারদের  প্রতি শ্রদ্ধা রেখে ইন্দ্র কায়ধুকে ছেড়ে অমরাবতী চলে যান।

নারদজী কায়ধুকে তাঁর আশ্রমে নিয়ে এসে বললেন- “কন্যা!  তোমার স্বামী তপস্যা করে ফিরে না আসা পর্যন্ত তুমি এখানেই থাকো তোমার কোন অসুবিধা হবে না।

যথাসময়ে কায়ধু একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দেন।যার নাম রাখা হয় প্রহ্লাদ।


আর এদিকে ব্রহ্মাজি হিরণ্যকশিপুর কঠোর তপস্যায় সন্তুষ্ট হন।এবং বর চাইতে বললেন।এই কথা শুনে হিরণ্যকশিপু বললেন- “প্রভু!  যদি তুমি আমাকে কাঙ্খিত বর দিতে চাও, তবে আমাকে অমরত্ব বর দাও। ব্রহ্মা বললেন না প্রতিটি জীবেরই যখন সৃষ্টি আছে তার ধ্বংসও আছে।তাই প্রতিটি জীবকেই একদিন না একদিন মরতেই হবে। সেহেতু তোমাকে আমি অমরত্ব বর দিতে পারব না। তবে তোমাকে আমি এমন বর দেবো যা এই পৃথিবীতে দুর্লভ।তুমি আমার দ্বারা সৃষ্ট কোন প্রাণী তোমাকে না মারতে পারবে না - সে মানুষ হোক বা পশু, দেবতা হোক বা রাক্ষস বা সর্প। ভিতরে-বাইরে, দিনে-রাতে, অস্ত্রের আঘাতে, পৃথিবীতে বা আকাশে তোমাকে কেউ মারতে পারবে না। 


বিষ্ণুর দশ অবতার
নৃসিংহ অবতার


হিরণ্যকশিপু বর পেয়ে মহা আনন্দে রাজধানীতে ফিরে এলেন। রাজধানীতে ফিরে এলেন।আর এদিকে কায়ধুও নারদের আশ্রম থেকে প্রাসাদে ফিরে এলেন।


এর পর হিরণ্যকশিপু পুত্র প্রহ্লাদের শিক্ষার ব্যবস্থা করেন।  ধীরে ধীরে প্রহ্লাদের বয়স বাড়ার সাথে সাথে ভগবান বিষ্ণুর প্রতি তার ভক্তি ও বিশ্বাস বাড়তে থাকল। তাই দেখে পিতা ক্রুদ্ধ হলেন। পিতা প্রহ্লাদকে বললেন দানবের সন্তান হয়ে তুমি দেবতার গুনগান গাইছো,দেবতার ভজনা করছো। তাই পিতা হিরণ্যকশিপু তাকে গুরু শুক্রাচার্যের কাছে শিক্ষার জন্য দিয়ে এলেন। কিন্তু গুরু শুক্রাচার্যের কাছে দানবীয় শিক্ষা তার মোটেই ভাল লাগলো না তাই সে রাজপ্রাসাদে ফিরে এলেন।


একদিন পিতা হিরণ্যকশিপু পুত্রকে কোলে বসিয়ে বললেন এতদিন তুমি গুরুর কাছে কি শিক্ষা লাভ করলে তা আমায় বলো।


তখন প্রহ্লাদ জবাব দিলেন শ্রবণ,কীর্তন, স্মরণ,পাদসেবন, অর্চন, বন্দন, দাস্য,সখ্য ও আত্মনিবেদন এই হল নয় প্রকার ভক্তি।এই শিক্ষা লাভ করে ভগবানের চরণে নিজের মন প্রাণ সঁপে দেওয়াটাই  হল শ্রেষ্ট্য বিদ্যা। অথচ আপনি যে গুরুর কাছে শিক্ষার জন্য আমাকে পাঠিয়ে ছিলেন তাঁর এর সম্বন্ধে কোন জ্ঞানই নেই।

এই কথা শুনে হিরণ্যকশিপু ক্রোধান্বিত হয়ে প্রহ্লাদকে কোল থেকে নিচে ফেলে দেন এবং রাক্ষসদের আদেশ দেন তাঁকে হত্যা করার।


অতঃপর অসুররা প্রহ্লাদকে হত্যা করার জন্য অনেক ব্যবস্থা নিল, কিন্তু প্রতিবারই ঈশ্বরের কৃপায় প্রহ্লাদ রক্ষা পেল।  কোনোভাবেই রাক্ষসরা প্রহ্লাদকে হত্যা করতে পারল না।

অতঃপর একদিন হিরণ্যকশিপু প্রহ্লাদকে ডেকে বললেন- “হে দুষ্ট!  কার জোরে তুমি এমন ছলনাময় কথা বলো? কে তোমার ঈশ্বর? কোথায় তোমার ঈশ্বর? তিনি যদি সর্বত্রই থাকেন তবে এই স্তম্ভে আমি কেন তাকে দেখতে পাচ্ছি না?  

তখন প্রহ্লাদ বললেন- এইতো আমি স্তম্ভের মধ্যে তাকে দেখতে পাচ্ছি।এ কথা শুনে হিরণ্যকশিপু ক্রোধ সংবরণ করতে না পেরে হাতে তলোয়ার নিয়ে সিংহাসন থেকে লাফ দিয়ে স্তম্ভে আঘাত করলেন।


ঠিক সেই মূহুর্তে সেই স্তম্ভ থেকে একটি ভয়ানক শব্দ বেরিয়ে এল এবং সেই স্তম্ভ ভেঙ্গে এক অদ্ভুত প্রাণী বের হল যার দেহ অর্ধেক সিংহের এবং অর্ধেক মানুষের।

এই ছিল ভগবান শ্রীহরির নরসিংহ অবতার।  তার রূপ ছিল ভয়ঙ্কর।  তার পোড়া সোনার মতো ফ্যাকাশে হলুদ চোখ, তার বিশাল ধারালো দাঁত এবং সে ভয়ানক শব্দে গর্জন করছিল।  কেউ তার কাছে যাওয়ার সাহস পাচ্ছিল না।এই দেখে হিরণ্যকশিপু প্রচন্ড ক্রুদ্ধ হয়ে হাতে গদা নিয়ে ভগবান নরসিংহের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল বধ করার জন্য।অতঃপর ভগবানও হিরণ্যকশিপুর সাথে তুমুল যুদ্ধ করল এবং অবশেষে তাকে ধরে প্রাসাদের  দরজার চৌকাঠে নিয়ে গিয়ে উরুতে ফেলে দেন এবং ধারালো নখ দিয়ে তার কলিজা ছিঁড়ে মাটিতে ফেলে দেন।

তার রাগান্বিত চেহারা দেখে  তার কাছে যেতে কেউ সাহস পেল না।

হিরণ্যকশ্যপের মৃত্যুর সংবাদ শুনে ব্রহ্মা, ইন্দ্র, শঙ্কর, সমস্ত দেবতা, ঋষি, সিদ্ধ, নাগ, গন্ধর্ব প্রভৃতি  সবাই অঞ্জলি ভরে আলাদা আলাদাভাবে ভগবানের স্তব করলেন। তাতেও কিন্তু ভগবান নরসিংহের ক্রোধ হল কমল না।

তখন দেবতারা মাতা লক্ষ্মীকে তাদের কাছে পাঠালেন, কিন্তু ভগবানের উগ্র রূপ দেখে তিনিও ভয় পেয়ে গেলেন।তখন ব্রহ্মা প্রহ্লাদকে বললেন- “পুত্র!  ভগবান তোর বাবার উপর রাগ করেছিল, এখন তুই গিয়ে ওকে শান্ত কর। তখন প্রহ্লাদ হাত জোড় করে ভগবানের কাছে গিয়ে মাটিতে প্রণাম করে তাঁর গুনগান গাইতে লাগলেন।

একটি ছোট ছেলেকে পায়ের কাছে শুয়ে থাকতে দেখে ভগবান করুণাময় হয়ে প্রহ্লাদকে উঠিয়ে কোলে বসিয়ে স্নেহভরে বললেন-

"সাবাস প্রহ্লাদ!  তোমার মতো এমন প্রেমিক ভক্ত পেয়ে আমি মুগ্ধ।বল তুই কি বর চাস?

প্রহ্লাদ বললেন হে প্রভু!যে জিনিস মানুষের মনকে মলিন করে তা আমি চাইনা। যে কামবীজ প্রাণ,আত্মা,ধর্ম,ধৈর্য, তেজ, বুদ্ধি, লজ্জা,শোভা,স্মৃতি ও সত্যকে ধ্বংস করে সেই কাম বীজের বিনাশ চাই আমি।আপনি আমাকে সেই বর দান করুন।

নৃসিংহদেব বললেন-হে প্রহ্লাদ জানি তুমি আমার পরম ভক্ত।তোমার মত ভক্তদের এই  পরলোকে বা ইহলোকে ভোগ-বিলাসের কোন বাসনা থাকে না।তা সত্ত্বেও তোমাকে এই মন্বন্তর পর্যন্ত দৈত্যকুলের বাস করে  দৈত্যকুলের সমস্ত ফল ভোগ  করতে হবে।

তাপর তুমি আমার কাছে আসবে, সমস্ত বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে।সময়মতো শরীর ত্যাগ করে, পুণ্যকর্ম করে পাপ ধ্বংস করে, পুণ্যকর্মের ফল ভোগ করে।  দেবলোকেও তোমার কীর্তি গাইবে।  


এই বলে ভগবান নরসিংহ সেখান থেকে অদৃশ্য হলেন।


বামন অবতার


ভববান বিষ্ণুর দশ অবতারের মধ্যে পঞ্চম অবতার হল বামন অবতার। মহামতী রাজা বলি ছিলেন শ্রীহরির পরম  ভক্ত প্রহ্লাদের পৌত্র্র এবং বিরোচনের পুত্র। দৈত্যগুরু শুক্রাচার্য্যের শিক্ষায় ও আশীর্বাদে পরম শক্তিশালী রাজা হয়ে ওঠে।মহা শক্তিশালী রাজা বলি মর্ত্যলোক এবং পাতাল অধিকারের পর স্বর্গলোক অধিকার করার জন্য দৈত্যগুরু শুক্রাচার্য্যের পরামর্শে বিশ্বজিৎ যজ্ঞ আরম্ভ করেন। সেই যজ্ঞে আহুতি দেবার সঙ্গে সঙ্গে যজ্ঞকুন্ড থেকে উঠে এল দেবরাজ ইন্দ্রের রথের মতো বহু মূল্যবান রত্নখোচিত সুসজ্জিত রথ,দুটি তীরযুক্ত অক্ষয় বাণ, স্বর্ণ ময় ধনু, সিংহ চিহ্নিত ধ্বজা,দিব্য কবচ এবং দিব্যবর্ম।উপস্থিত প্রজাপতি ব্রহ্মা দান করিলেন দিব্যমাল্য আর শুক্রাচার্য্য দান করলেন দিব্য শঙ্খ। যজ্ঞকুন্ড হইতে আবির্ভূত সমস্ত দিব্যবস্তু ধারণ করিয়া মহারাজ বলি নতজানু হয়ে পিতামহ প্রহ্লাদ, গুরু শুক্রাচার্য্য এবং যজ্ঞ ভূমিতে উপস্থিত সমস্ত ঋষিদের আশীর্বাদ প্রার্থনা করিলেন। তাঁদের আশীর্বাদে পেয়ে বলি স্বর্গরাজ্য আক্রমণের জন্য  ধাবিত হলেন।



স্বর্গে পৌঁছে দিব্য শঙ্খ বাজাইলেন। সেই শঙ্খ ধ্বনি তে সমস্ত দেবতা ভীত হইয়া দেবরাজ ইন্দ্রের সাহায্য চাইলেন। দেবরাজ ইন্দ্র বলির তেজ, সাহসিকতা,এবং সুদক্ষ সেনাবাহিনীর সামনে পরাজিত হল।তখন দেবতাদের স্বর্গ হইতে বিতাড়িত করিয়া বলিরাজ স্বর্গ, মর্ত্য ও পাতাল দখল করিয়া  ত্রিলোকে শাসন করিতে লাগিলেন। দেবতাদের এমন  দুর্দশা  দেখিয়া  মাতা অদিতি ও পিতা কশ্যপ ভগবান বিষ্ণুর শরণাপন্ন হন যাতে দেবতার পুনরায় স্বর্গরাজ্য ফিরে পাই।এবং তারা বিষ্ণুর পূজা করতে থাকলেন। অদিতির পূজায় সন্তুষ্ট হয়ে ভগবান বিষ্ণু তাঁকে বর দেন যে তিনি তাঁর গর্ভে পুত্র রূপে জন্ম গ্রহণ করিবেন এবং দেবতাদের স্বর্গরাজ্যে পুনঃ প্রতিষ্ঠিত করিবেন।


বামন অবতার


যথাসময়ে শ্রীহরি বামন রূপে ধরাধমে অবতীর্ণ হলেন। শিশুর জন্মের সাথে সাথে তাঁর দেহের দিব্য জ্যোতিতে কশ্যপ মুনির আশ্রমের চর্তুদিক আলোয় ভরে উঠল। অন্ধকার দূরীভূত হল। সিদ্ধগণ, বিদ্যাধরগণ, কিন্নরগণ, নাগদেবতা এবং পিতৃদেবগণ স্তব করিতে থাকলেন। দেবগণ স্বর্গ হইতে কাশ্যপ মুনির আশ্রমে পুষ্পবৃষ্টি করিলেন। নবজাতকে দেখিয়া সপ্ত ঋষি (ভরদ্বাজ, গৌতম, কাশ্যপ, বিশ্বামিত্র, জমদগ্নি, বৈশিষ্ট্য এবং অত্রী), অষ্ট দিকপাল, বায়ুগণ, বিশ্বদেবগণ, সাধ্যদেবগণ, নাগদেবগণ কাশ্যপ মুনির আশ্রমে পদার্পণ করিলেন। শত সহস্র সূর্য্যের সমান জ্যোতির্ময় বালককে স্বয়ং প্রজাপতি ব্রহ্মা নতজানু হয়ে প্রণাম করিলেন। এবং দৈত্যরাজ বলিকে পরাজিত করিয়া স্বর্গরাজ্য পুর্নরুদ্ধারের জন্য করজোড়ে সবাই প্রার্থনা করিতে লাগিলেন। ধীরে ধীরে বালক বড় হইতে লাগিলেন। উপনয়নের সময় আগত হইলে সূর্য্যদেব স্বয়ং বালককে দিলেন গায়িত্রী মন্ত্র। দেবগুরু বৃহস্পতি দিলেন উপবীত, পিতা কশ্যপ দিলেন ব্রহ্মোপদেশ, ভূদেবী দিলেন পবিত্র মৃগচর্ম, চন্দ্রদেব দিলেন দণ্ড, মাতা অদিতি দিলেন কৌপিন্য, দেবী ভুবনেশ্বরী দিলেন স্বর্গীয় ছত্র, ব্রহ্মা দিলেন কমুন্ডল, সপ্তর্ষি দিলেন দুর্বা, দেবী স্বরসতী দিলেন জপমালা এবং কুবের দিলেন ভিক্ষাপাত্র। সমস্ত দিব্য ভূষণে ভূষিত হয়ে সেই জ্যোতির্ময় বালক অগ্রসর হইলেন মহাবলশালী রাজা বলির রাজসভার উদ্দেশ্যে, দেবতাদিগকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষার্থে।

 এদিকে তখন মহারাজা বলি গুরু শুক্রাচার্য্যের পরামর্শে অশ্বমেধ যজ্ঞ করছিলেন। এমন সময় বামন উপস্থিত হইলেন রাজা বলির অশ্বমেধ যজ্ঞশালায়। সাধারণ ব্রহ্মচারীর মতো পরিধান হইলেও বালকের বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা এবং দিব্য কান্তি দেখিয়া সকলে বিস্মিত হইলেন। রাজা বলি স্বয়ং বামন অবতারের পা ধৌত করিলেন এবং বলিলেন বালকের চাওয়ার আছে কিনা? ধন, সম্পদ, প্রতিপত্তি। আমি তাই দেব। আজ আমার কাছ হইতে যে যাহা চাহিবে আমি তাহাই দিতে প্রস্তুত।তখন বামন অবতার বলিলেন তাঁর সাম্রাজ্য, ঐশ্বর্য, প্রতিপত্তি প্রাপ্তির ইচ্ছা নাই। তাঁর প্রয়োজন কেবলমাত্র তিন পদ জমি। রাজা বলি বালকের এই সামান্য চাহিদা তাহার কাছে নির্বুদ্ধিতা মনে হইল। তাই বলি অট্টহাস্য করিতে লাগিলেন। বামন অবতার বলিলেন যে প্রয়োজন অনুযায়ী চাহিদাই হচ্ছে প্রকৃত চাহিদা। প্রয়োজনের অতিরিক্ত চাওয়া জীবনে অধর্ম, অসত্য, অতৃপ্তি এবং অন্যায়।সুতরাং তাঁর বাসনা তিন পদ জমি।  দাতা বলি বামন অবতারের ইচ্ছায় সম্মত হইলেন। তখন সেখানে উপস্থিত গুরু শুক্রাচার্য্য বুঝিতে পারিলেন এ বালক কোন সাধারন বালক নন এ নিশ্চয় স্বয়ং ভগবান বিষ্ণু।বালকের প্রকৃত পরিচয় এবং অভিপ্রায় বুঝিতে পারিয়া গুরু শুক্রাচার্য্য রাজা বলিকে তা স্বীকার না করিবার জন্য অনুরোধ করিলেন।কিন্তু দানবীর বলির নিকট প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ হল আসলে মৃত্যুর সমান।


গুরুর সাবধানবানী অগ্রাহ্য করিয়া প্রতিজ্ঞা অনুযায়ী রাজা বলি জমি প্রদানের জন্য অগ্রসর হইলেন। সেই মূহুর্তে বামন অবতার বিশাল আকার ধারণ করিলেন। তখন একটি পদ  মর্ত্যলোকে রাখিলেন, সমস্ত পৃথিবী এবং আকাশ তাহা পরিব্যাপ্ত হইল। দদ্বিতীয় পদ রাখিলেন স্বর্গলোকে।এখন তৃতীয় পদটি কোথায় রাখিব তাহা জিঞ্জাসা করিলেন রাজা বলিকে। এমন সময় রাজা বলি দেখিলেন এখন আমার প্রমাণ করার সময় হয়েছে যে আমিও ভগবান বিষ্ণুর একজন ভক্ত। তাই মহারাজ বলি তৃতীয় পদটি  রাখিবার  জন্য তার নিজ মস্তক অগ্রসর করিয়া দিলেন।বামন অবতার বলির মস্তকে পা রাখিবার সঙ্গে সঙ্গে বলির পাতাল প্রবেশ হইল। ভগবান নারায়ণ বলিকে পাতাললোকে প্রেরণ করিলেন। এইভাবে স্বর্গরাজ্য পুনরায় দেবতাদের অধীনে আসিল।

শ্রীহরিবিষ্ণু রাজা বলিকে আশীর্বাদ করিলেন যে তিনি চিরঞ্জিবী হইবেন। দৈত্যকুলের শ্রেষ্ঠ সম্রাট এবং শ্রীহরির প্রিয়ভক্ত হিসাবে মর্ত্যলোকে পূজিত হইবেন। তাই কার্তিক মাসের শুক্ল পক্ষের প্রতিপদ তিথিতে মহারাজা বলির পূজা হয়ে থাকে।


পরশুরাম অবতার


ভববান বিষ্ণুর দশ অবতারের মধ্যে ষষ্ঠ্য অবতার হল পরশুরাম অবতার। পুরাণে বর্ণিত ঋষি জমদগ্নি ও স্ত্রী রেণুকার পাঁচ সন্তান। বসু, বিশ্ববসু, বৃহৎ-ভানু, বৃহৎ-কণ্ব ও পরশুরাম। পরশুরাম ছিলেন তাদের কনিষ্ঠ সন্তান। পরশুরামের জন্ম নিয়ে নানা কাহিনী প্রচলিত রয়েছে। ভাগবত পুরাণ অনুসারে, একসময় সমাজে  ক্ষত্রিয় রাজ রাজাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি এত বেড়ে  যায় যে তাদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে পৃথিবী।তখন তারা সকলে ব্রক্ষা ও বিষ্ণুর স্মরণ নেয়।তাই ক্ষত্রিয়দের শায়েস্তা করার জন্য ব্রহ্মা ও বিষ্ণুর বরে পরশুরাম জন্মগ্রহণ করেন।


হিন্দু পুরাণে বর্ণিত এক বর্ণময় চরিত্র ভগবান পরশুরাম :


আবার অন্য একটি গল্প অনুযায়ী - পৃথিবী স্বয়ং একটি গাভীর রূপ ধারণ করে বিষ্ণুর কাছে নিজের দুঃখ-দুর্দশার কথা জানিয়েছিলেন। তখন বিষ্ণু পরশুরাম হয়ে জন্মগ্রহণ করে সেই দুঃখ-দুর্দশা দূর করবেন বলে পৃথিবীকে কথা দেন।


পরশুরাম ব্রাহ্মণ হয়েও  কর্মে ছিলেন পুরোপুরি ক্ষত্রিয়


মহর্ষি জমদগ্নির আশ্রমে তার সকল সন্তানরা যখন বেদ-বেদান্ত চর্চায় নিয়োজিত থাকতেন। তখন পরশুরামের তাতে কোনো উৎসাহই ছিল না বরং অস্ত্র চালনার কৌশল শিখতেই তিনি বেশি মনোযোগী ছিলেন।  অল্প বয়স থেকেই তিনি ছিলেন প্রচন্ড দাম্ভিক, ক্রোধী ও প্রতিহিংসাপরায়ণ। ক্ষত্রিয় বংশকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে ব্রহ্মার তপস্যা শুরু করলেন।কঠোর তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে ব্রহ্মা তাকে  বেশ কয়েকটি মারণাস্ত্র দান করেন।

ভগবান পরশুরাম মহাদেবকে তুষ্ট করে পরশু অর্থাৎ কুঠার অস্ত্রটি লাভ করেন। সেই থেকে তার নাম হয় পরশুরাম। তার প্রকৃত নাম ছিল রাম। মহাদেবের নির্দেশে এ অস্ত্র দিয়ে তিনি অনেক অসুরকে বধ করেন। ধীরে ধীরে তিনি হয়ে উঠলেন এক মহা পরাক্রমশালী যোদ্ধা। তাই পরশুরাম ব্রাহ্মণ ঘরে জন্মগ্রহণ করলেও কর্মে তিনি হয়েছিলেন ক্ষত্রিয়। 

মাতৃহত্যার কারণে পরশুরাম হয়েছিলেন অভিশপ্ত  :


একদিন ঋষি জমদগ্নি তার কুটীরে যজ্ঞের আয়োজনে ব্যস্ত ছিলেন।আর তার স্ত্রী রেণুকা জল আনতে নদীতে গেলেন। সেই সময় সেই নদীতে চিত্ররথ নামে এক রাজা তার স্ত্রীদের সাথে জলবিহার করছিলেন। তা দেখে রেণুকা কামার্ত হয়ে পড়েন। এদিকে রেণুকা তখনও কুটিরে ফিরে না আসায় চিন্তিত ঋষি ধ্যানযোগে জানতে পারলেন  তার স্ত্রীর প্রকৃত  অবস্থা। তাই দেখে ঋষি অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হলেন। তৎক্ষণাৎ ঋষি পুত্রদেরকে মাতৃহত্যার আদেশ দেন।কিন্তু ঋষির প্রথম চার সন্তানই পিতার এ আদেশ পালন করতে রাজি হননি। কারণ তারা মনে করত মাতৃহত্যা মহাপাপ।তখন ঋষি ক্রুদ্ধ হয়ে তার চার সন্তানকে জড়ত্বের অভিশাপ দেন। শেষে ঋষি তার কনিষ্ঠ সন্তান পরশুরামকে একই আদেশ দেন। এই আদেশ পেয়ে পরশুরাম সঙ্গে সঙ্গে কুঠার দিয়ে তার মায়ের শিরশ্ছেদ করেন।

পিতৃ আজ্ঞা পালন করায় জমদগ্নি পুত্রের উপর বেশ সন্তুষ্ট হলেন। তাই ঋষি পরশুরামকে বর চাইতে বললেন। পরশুরাম বললেন পিতা তুমি আমায় এই বর দিন যাতে মায়ের যেন পুনর্জন্ম হয়,ভাইরা যেন জড়ত্ব থেকে মুক্তি পাই, নিজের দীর্ঘায়ু ও অমরত্বের বর দিন। ঋষি জমদগ্নি তাই বর দিলেন।কিন্তু মাতৃহত্যাজনিত পাপে পরশুরামের হাতে কুঠারটি লেগেই রইলো। কিছুতেই তিনি হাত থেকে কুঠারটি ছাড়াতে পারলেন না। পিতার কাছে এর কারণ জানতে চাইলেন পরশুরাম। পিতা তাকে জানান, মাতৃহত্যার পাপ থেকে মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত এ কুঠারটি তার হাত থেকে বিযুক্ত হবে না। পিতার আদেশে ব্রহ্মকুণ্ডে স্নান করার পর মাতৃহত্যার পাপ থেকে তিনি মুক্ত হন এবং তার হাত থেকে কুঠারটি বিচ্ছিন্ন হয়।

পুরাকালে কার্তবীর্য নামে এক রাজা ছিলেন। তার আসল নাম ছিল কার্তবীর্যার্জুন। একবার তিনি পুত্রদের নিয়ে মহর্ষি জমদগ্নির আশ্রম দর্শনে আসেন। সেখানে আশ্রমে থাকা কামধেনু গাভীকে দেখে তিনি এতটাই মুগ্ধ হয়ে যান যে, রাতের আঁধারে সেই কামধেনু চুরি করে রাজা তার রাজ্যে নিয়ে আসেন। বিষয়টি জানতে পেরে পরশুরাম রাজাকে হত্যা করে সেই কামধেনুটি আশ্রমে ফিরিয়ে আনেন। এদিকে কার্তবীর্যের পুত্ররা প্রতিশোধ নিতে রাতের আঁধারে জমদগ্নির আশ্রমে হানা দেয়। ধ্যানরত জমদগ্নিকে তারা নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেন। আশ্রম কুটিরে পিতার বীভৎস মরদেহ দেখে ক্ষুব্ধ পরশুরাম একাই কার্তবীর্যের সব পুত্রকে বধ করেন।


পরশুরাম পৃথিবী থেকে একুশবার ক্ষত্রিয়শূন্য করেন;

পরবর্তীকালে তিনি ক্ষত্রিয়দের উপর এতটাই প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে পড়েন যে একুশবার তিনি পৃথিবী থেকে ক্ষত্রিয়শূন্য করেন। প্রথমবার পৃথিবী থেকে ক্ষত্রিয়শূন্য হওয়ার পর কীভাবে পরশুরাম আরও বিশবার ক্ষত্রিয়শূন্য করেছিলেন, তা জানতে হলে সে সময়ের সমাজব্যবস্থা সম্পর্কে একটু ধারণা নিতে হবে। তৎকালীন সমাজে ব্যক্তির কর্মের ভিত্তিতে তার বর্ণ নির্ধারিত হতো। যারা রাজ্য পরিচালনা ও যুদ্ধের কাজে নিয়োজিত থাকতেন, তারাই ক্ষত্রিয় বলে বিবেচিত হতেন। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে এরও ব্যতিক্রম ছিল।

ক্ষত্রিয়দের হত্যা করে তাদের রক্ত দিয়ে পরশুরাম পাঁচটি হ্রদ তৈরি করেন। কিন্তু তারপরই তার ভীষণ অনুশোচনা হয়। তিনি পিতৃপুরুষের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং অনুরোধ করেন, যাতে পাঁচটি হ্রদ পবিত্র বলে বিবেচিত হয়। পরশুরামের পিতৃপুরুষ তাকে পাপমুক্ত করেন এবং পাঁচটি রক্ত হ্রদ একসাথে সমন্তপঞ্চক বা কুরুক্ষেত্র বলে পরিচিতি লাভ করে।


ভীষ্ম ও কর্ণের শিক্ষাগুরু ছিলেন পরশুরাম


পরশুরাম ছিলেন কুরু পিতামহ ভীষ্ম ও কর্ণের অস্ত্রগুরু। একদা ভীষ্ম তার সৎ ভাই বিচিত্রবীর্যের বিয়ের জন্য কাশীরাজের তিন কন্যাকে অপহরণ করে নিয়ে আসেন। কাশীরাজের বড় মেয়ে অম্বা জানান যে, তিনি আগে থেকে শাম্বরাজকে স্বামী হিসেবে মেনে নেয়ায় বিচিত্রবীর্যকে বিয়ে করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। তখন ভীষ্ম অম্বাকে শাম্বরাজের কাছ পাঠিয়ে দেন। কিন্তু শাম্বরাজ অম্বাকে আর গ্রহণ না করায় অম্বা ভীষ্মের কাছে ফিরে আসেন এবং তাকে বিয়ে করার জন্য অনুরোধ জানান।


বিষ্ণুর দশ অবতার
পরশুরাম অবতার


কিন্তু ভীষ্ম আজন্ম ব্রহ্মচারী থাকার প্রতিজ্ঞা করায় তার পক্ষে অম্বাকে বিয়ে করা সম্ভব নয় বলে জানান। অম্বা তখন পরশুরামের কাছে ন্যায়বিচার প্রার্থনা করেন। পরশুরাম এসেও ভীষ্মকে এই বিয়েতে রাজি করাতে ব্যর্থ হলেন। তখন পরশুরামের সাথে ভীষ্মের ভীষণ যুদ্ধ শুরু হয়। ২৩ দিন যুদ্ধের পরও পরশুরাম ভীষ্মকে পরাজিত করতে ব্যর্থ হয়ে প্রতিজ্ঞা করেন, জীবনে আর কোনো ক্ষত্রিয়কে অস্ত্রশিক্ষা দেবেন না। এরপর পরশুরাম মহেন্দ্র পর্বতে মহাদেবের কঠোর তপস্যায় ব্রতী হন। 

বেশ কিছুদিন পরের কথা। মহাবীর কর্ণ অস্ত্রশিক্ষা লাভের জন্য পরশুরামের কাছে উপস্থিত হন। কর্ণ জানতেন যে, পরশুরাম ক্ষত্রিয়বংশজাত কোনো ব্যক্তিকে অস্ত্রশিক্ষা দেবেন না। তাই কর্ণ নিজের পরিচয় গোপন করে পরশুরামের কাছে অস্ত্রশিক্ষা নিতে থাকেন এবং নিজেকে একজন বড় ধনুর্বিদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন।

নিজের বংশ পরিচয় গোপন করার জন্য পরশুরাম কর্ণকে দেয়া সব অস্ত্রের ব্যবহার ভুলে যাওয়ার অভিশাপ দেন

গুরুর কাছ থেকে বিভিন্ন অস্ত্রের ব্যবহারের কৌশল রপ্ত করতে সক্ষম হন। কিন্তু একদিন পরশুরাম কর্ণের ছলনার কথা জানতে পারেন। মিথ্যে পরিচয় দিয়ে অস্ত্রশিক্ষা লাভ করায় পরশুরাম কর্ণের ওপর ভীষণ ক্রুদ্ধ হন। তিনি কর্ণকে অভিশাপ দেন যে, অন্তিম মুহূর্তে কর্ণ পরশুরামের কাছে পাওয়া বড় বড় অস্ত্রের ব্যবহারের কৌশল ভুলে যাবেন। এ কারণেই কুরুক্ষেত্রে কর্ণের করুণ মৃত্যু ঘটেছিল।

রামায়ণেও তার ভূমিকা ছিল সদা উজ্জ্বল

রামায়ণ ও মহাভারত দুইটি ভিন্ন যুগের কাহিনী হলেও এই দুই মহাকাব্যেই তার উপস্থিতি বেশ লক্ষণীয়। মহেন্দ্র পর্বতে দীর্ঘদিন তপস্যা করার পর প্রচুর ব্রহ্মতেজ অর্জনের পর পরশুরাম পর্বত থেকে নেমে আসেন। সমতলে নেমেই প্রথমে তিনি অযোধ্যার রাজা রামের মুখোমুখি হলেন। রাম তখন সবে হরধনু ভঙ্গ করে ফিরেছেন।এই হরধনুটি পরশুরাম জনক রাজাকে উপহার দিয়েছিলেন।

জনকরাজা শর্ত রেখেছিলেন যে এই ধনুকে যে ব্যক্তি গুন পরাতে পারবেন, তার সঙ্গেই তিনি তার কন্যা সীতার বিয়ে দেবেন। রাম সে হরধনু ভঙ্গ  করে সীতাকে বিয়ে করেন। হরধনু ভঙ্গের কথাটি জানতে পেরে পরশুরাম রামের উপর ভীষণ অসন্তুষ্ট হলেন।

রামকে দেখেই তিনি আবার ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলেন। তিনি রামকে বললেন তোমার  যদি এতই শক্তি, তবে তুমি যেন তার বৈষ্ণবী ধনুকে গুন পরিয়ে দেখান। একথা শুনে রাম তো ভয়ানক রেগে গেলেন। তিনি বান মেরে পরশুরামের স্বর্গে যাওয়ার সব রাস্তা বন্ধ করে দিলেন।

এদিকে ক্ষুদ্ধ ও পরাজিত পরশুরাম পুনরায় মহেন্দ্র পর্বত ফিরে গেলেন এবং দেখলেন এতদিন যেটুকু শক্তি তিনি অর্জন করেছিলেন তা রামের সাথে অকারণে লড়াই করতে গিয়ে সেটুকুও বিনষ্ট হয়ে গিয়েছে। ওদিকে স্বর্গে যাওয়ার সব রাস্তাও বন্ধ। পরে তিনি পূর্বপুরুষদের কাছে ক্ষমা ভীক্ষা চেয়ে মোক্ষলাভ করেন।


রাম অবতার 


ভববান বিষ্ণুর দশ অবতারের মধ্যে সপ্তম অবতার হল রাম অবতার।রঘুকুলে দশরথ নামে এক প্রতাপশালী রাজা ছিলেন।  মহারাজ দশরথ তিনটি বিয়ে করেছিলেন, কিন্তু বৃদ্ধ হয়ে গেলেও তাঁর কোন পুত্রসন্তান হয়নি।


হতাশ হয়ে তিনি তাঁর উপাচার্য বশিষ্ঠ মুনির আশ্রমে যান। মহর্ষি বশিষ্ঠের পরামর্শে দশরথ শৃঙ্গী ঋষিকে ডেকে পুত্রেষ্ঠী যজ্ঞ করেন।

যজ্ঞ শেষ হওয়ার পর অগ্নিদেব স্বয়ং আবির্ভূত হন এবং চারুকে দশরথের হাতে তুলে দেন। ঐ দিব্য চারুকে পেয়ে রাজা দশরথের তিন রানী গর্ভবতী হলেন।

সেই সময় সকল দেবতারা রাক্ষস রাজা রাবণের অত্যাচারে অতিষ্ঠ্য হয়ে উঠেছিল। লঙ্কা পতি রাবণ ছিলেন ছিলেন ঋষি, ব্রাহ্মণ, দেবতা ও ধর্মের শত্রু।  তিনি জোরপূর্বক দেবতা ও মুনি ঋষিদের যজ্ঞ, পূজা ইত্যাদি বন্ধ করে দেন।

রাক্ষসরা উন্মত্ত হয়ে ঋষিদের হত্যা করতে থাকলো। রাবণ সমস্ত দেবতাকে পরাজিত করে তাঁর আদেশ মানতে বাধ্য করেছিলেন।

পৃথিবী এই অধর্মের প্রচণ্ড ভার সইতে না পেরে দেবতাদের সকলে ভগবান বিষ্ণুর শরণাপন্ন হন।

তারপর তাদের প্রার্থনায়, ভগবান বিষ্ণু রামারূপে দশরথ ও কৌশল্যার পুত্ররূপে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হন। অন্য রানী সুমিত্রার দুই পুত্র ছিল, লক্ষ্মণ ও শত্রুঘ্ন এবং কেকায়ীর একটি পুত্র ছিল, ভরত।

চার কুমার বড় হয়ে উপাচার্য বশিষ্ঠের কাছ থেকে অস্ত্র ও শাস্ত্রের শিক্ষা লাভ করেছিলেন।  একদিন ঋষি বিশ্বামিত্র অসুরদের ভয়ে রাজা দশরথের কাছে আসেন।

তিনি রাজা দশরথের কাছে রাম ও লক্ষ্মণকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন।  একথা শুনে দশরথ তাঁর চতুরঙ্গিনী সেনাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে বললেন।

কিন্তু বিশ্বামিত্র মুনি তার উপদেশকে যথাযথ মনে করেননি কারণ এতে তার তপস্যা বাধাগ্রস্ত হতো।

কুলগুরু বশিষ্ঠের কথায় দশরথ রাজি হন এবং রাম লক্ষ্মণকে বিশ্বামিত্রের সঙ্গে বনে যাওয়ার নির্দেশ দেন।

রাম লক্ষ্মণ বনে গিয়ে সমস্ত তপোবনকে অসুরশূন্য করে দিলেন।  ঋষিরা সকলে  বিনা বাধায় আগের মতই আরাধনা ও তপস্যা করতে লাগল।

ইতিমধ্যে ঋষি বিশ্বামিত্র বিদেহরাজ জনকের কাছ থেকে আমন্ত্রণ পান। রাম লক্ষন তার গৃহে আশ্রয় গ্রহণ করেন। তাঁর কন্যা সীতার  স্বয়ম্বর ছিল।  

রাজা জনক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে ভগবান শিবের অবিচ্ছিন্ন ধনুক যে ভেঙ্গে দেবে সে আমার কন্যা সীতাকে বিয়ে করবে।  ভগবান শ্রী রাম হরধনু ভঙ্গ করে মিথিলা রাজার এই প্রতিশ্রুতি পূরণ করেছিলেন।

শুভ লগ্নে রাম ও সীতার বিবাহ সম্পন্ন হয়। সেই সঙ্গে জনক রাজার অপর কন্যা ঊর্মিলার সঙ্গে বিয়ে হয় লক্ষনের এবং জনকের ভাই কুশধ্বজের দুই কন্যা মান্ড্যবী ও শ্রুতকীর্ত্তীর বিবাহ হয় লক্ষণ ও শত্রুঘ্নর সঙ্গে।

ধনুক ভাঙ্গার খবর পেয়ে পরশুরাম ক্রোধে সেখানে পৌঁছেন, কিন্তু রামের বিনয়, শক্তি ও তেজ দেখেই  ফিরে আসেন।

দশরথ ও বশিষ্ঠের পাশাপাশি সমগ্র জনতা ভগবান শ্রী রামের রাজ্যাভিষেক চেয়েছিল।এদিকে দাসী মন্থরার কুমন্ত্রনায় মা কৈকেয়ী দেবতাদের অনুপ্রেরণায় মুগ্ধ হয়ে দশরথের কাছে প্রতিশ্রুতি দিয়ে দুটি বর পেয়েছিলেন।প্রথম বরে তার পুত্র ভরতকে অয্যোধার রাজা করতে হবে আর দ্বিতীয় বরে রামকে চৌদ্দ বছরের জন্য বনবাসে পাঠাতে হবে। 

পিতার প্রতিশ্রুতি রক্ষার জন্য, শ্রী রাম লক্ষ্মণ ও মাতা সীতাকে সঙ্গে নিয়ে তপস্বীর ছদ্মবেশে বনে গমন করেন । মহারাজ দশরথ তাঁর প্রিয় পুত্রের বিচ্ছেদে হা-রাম হা- রাম বলে কাঁদতে কাঁদতে জীবন বিসর্জন দেন।

যখন এই ঘটনা ঘটেছিল, তখন ভরত তার মাতুলালয়ে ছিলেন।  এই খবর শুনে তিনি অবিলম্বে অযোধ্যায় ফিরে আসেন এবং পিতার শেষকৃত্য সম্পন্ন করেন।এরপর শ্রী রামকে ফিরিয়ে আনতে ভাই ভরত চিত্রকূটে পর্বতে পৌঁছান।

কিন্তু শ্রী রামের নির্দেশে, তিনি তার পায়ের খড়ম ( পাদুকা )নিয়ে অযোধ্যায় ফিরে আসেন এবং সেই পদুকা দুটি ভগবান শ্রী রামের প্রতীক হিসেবে সিংহাসনে স্থাপন করেন।

স্বয়ং ভরত, একজন তপস্বীর ছদ্মবেশে চৌদ্দ বছর শহরের বাইরে থেকেছিলেন এবং শ্রী রামের প্রতিনিধি হয়ে অযোধ্যা শাসন করার সংকল্প করেছিলেন।

এদিকে ভগবান শ্রী রামচন্দ্র মহর্ষি অত্রি ও সতী অনসূয়ার দর্শনের পর চিত্রকূট ত্যাগ করেন এবং পথে বিরধা নামে এক অসুরকে হত্যা করেন।

চিত্রকূট থেকে যাত্রা করে শ্রী রাম ভরদ্বাজ, শরভাং, সুতীক্ষ্ণ, অগস্ত্য প্রভৃতি ঋষিদের দেখে দণ্ডকারণ্যে পৌঁছেন এবং সেখানে গাছের পাতা দিয়ে কুটির নির্মাণ করে বনের মধ্যে দিন অতিবাহিত করতে লাগলেন।

একদিন রামচন্দ্র বনের মধ্যে ভ্রমন করছেন, এমন সময় সেখানে রাবণের বোন সুর্পনখা সেখানে পৌঁছে শ্রীরামের প্রতি মুগ্ধ হয়ে বিবাহ করার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন।এতে মর্যাদা পুরুষোত্তম শ্রী রাম অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হলেন এবং ভাই লক্ষ্মণকে নির্দেশ দিলেন সুর্পনখার নাক ও কান কেটে নেওয়ার জন্য।

এরপর সূর্পনখা রাবণের কাছে পৌঁছে তার এই অবস্থার কথা বর্ণনা করেন। সব কথা শুনে লঙ্কা পতি রাবণ রাজা ভীষণ ক্ষুব্ধ হলেন এবং কিভাবে রামের প্রতি প্রতিশোধ নেওয়া যায় সেই চিন্তা করতে লাগলেন।

একদিন রাবণ মারিচকে সঙ্গে নিয়ে সোনার হরিণের ছদ্দবেশে সীতাকে প্রতারিত করে হরণ করে নিয়ে চললেন লঙ্কা পুরীতে।

এদিকে রামচন্দ্র বন থেকে ফিরে এসে দেখে কুঁড়েঘর খালি  সীতা নেই। তখনি রামচন্দ্র বেরিয়ে পড়লেন সীতার খোঁজে। পথিমধ্যে  শকুন রাজা জটায়ুর সাথে দেখা হয়ে গেল। ডানাকাটা অবস্থায় তখন জটায়ু প্রাণে বাঁচার জন্য ছটফট করছিল।কারন জটায়ু সীতাকে উদ্ধার করার জন্য রাবণ রাজা কে বাধা দিয়েছিলেন। তখন রাবণ রাজা ক্রুদ্ধ হয়ে তার দেহ থেকে একটা ডানা ছিন্ন করে দিয়েছিলেন।

কিন্তু জটায়ুর জীবন রক্ষা হল না। শ্রীরামের কোলে নিজের জীবন বিসর্জন দেন।  সরযু নদীর তীরে রামচন্দ্র জটায়ুর অগ্নি সৎকার করলেন।

সেখানে ভগবান শ্রীরাম হনুমানের সাথে দেখা করেন।  হনুমান বানররাজ সুগ্রীবের সাথে শ্রী রামের পরিচয় করালেন। রামচন্দ্র যখন সুগ্রীবকে  সীতা উদ্ধারের কাজে সাহায্য করতে বললেন তখন সুগ্রীব বললেন আমি নিজেই আমার ভাই বালির দ্বারা রাজ্য থেকে বিতাড়িত। তাই তুমি আমার রাজ্য ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিলে আমি সীতা উদ্ধারে তোমাকে  সাহায্য করবো।    এর পর শ্রী রামচন্দ্র বালিকে বধ করে সুগ্রীবের রাজ্যাভিষেক করেন।

এরপর সুগ্রীবের নির্দেশে ভাল্লুক ও বানরের দল চারদিকে সীতার সন্ধানে বেরিয়ে পড়ল।  তারপর মহাবীর হনুমান সীতার খোঁজে লঙ্কার উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন।

এরপর ভগবান শ্রী রাম সুগ্রীবের সাথে এক বিশাল বানর সৈন্য নিয়ে সমুদ্র উপকূলে এলেন। সেখানে সমস্ত বানর সেনারা পাথরে রাম নাম লিখে সমুদ্রে ভাসিয়ে দিলেন। এভাবে সমস্ত বানর সেনা মিলে সমুদ্রের উপর সেতু নির্মাণ করে করলেন। সেই সেতু দিয়ে সকলে লঙ্কায় পৌঁছালেন।

সীতা উদ্ধারের হেতু রাম রাবণের মধ্যে বিশাল যুদ্ধ শুরু হলো।এই যুদ্ধে রাবণ তার ভাই কুম্ভকরন, পুত্র ইন্দ্রজিৎ এবং সমগ্র রাক্ষসী বাহিনী সহ নিহত হন।

লঙ্কা জয় করার পর, বিভীষণের হাতে শাসনভার হস্তান্তর করে, লক্ষ্মণ ও সীতা সহ ভগবান শ্রী রাম পুষ্পক রথে অযোধ্যায় ফিরে আসেন এবং অযোধ্যার সিংহাসনে বসেন।

মর্যাদা পুরুষোত্তম শ্রী রামের 'রাম রাজ্য' এখনও সুশাসন, সুশৃঙ্খল এবং শান্তির একটি উজ্জ্বল উদাহরণ।


বলরাম অবতার  


ভববান বিষ্ণুর দশ অবতারের মধ্যে অষ্টম অবতার হল বলরাম অবতার। পুরাণে বলরামকে শেষনাগের অবতার বলে মনে করা হয়।


'এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে কৃষ্ণ কোন অবতার নন কারণ কৃষ্ণ কারো অংশ নন।কৃষ্ণ হতে সব সৃষ্টি, সব লয়।তিনিই হলেন এই জগতের সমস্ত কারনের কারন। কৃষ্ণ হল স্য়ং সম্পূর্ণ ভগবান।'


কথিত আছে যে কংস যখন দেবকী ও বসুদেবের ছয় পুত্রকে হত্যা করেছিলেন, তখন দেবকীর গর্ভে ভগবান বলরাম আবির্ভূত হন।  যোগমায়া তাকে আকৃষ্ট করে এবং নন্দ বাবার বাড়িতে অবস্থানরত শ্রী রোহিণীজির গর্ভে নিয়ে আসেন।  সেজন্য তিনি সংকর্ষণ নাম পেয়েছেন।

বলরাম রেবতীকে বিয়ে করেছিলেন।  পরাক্রমশালীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হওয়ার কারণে তাকে বলভদ্রও বলা হয়।  তার নামে মথুরায়  একটি বিখ্যাত মন্দির রয়েছে।  জগন্নাথের রথযাত্রায় তাদের রথও থাকে। জরাসন্ধ বলরামকে তার একমাত্র যোগ্য প্রতিপক্ষ হিসেবে মনে করতেন।  শ্রীকৃষ্ণ যদি বাধা না দিতেন তবে বলরাম জি তাকে প্রথম আক্রমণেই যমলোকে পাঠাতেন।


বলরাম মহাভারতের যুদ্ধে যোগ দেননি কেন?


ভগবান কৃষ্ণের বড় ভাই বলরাম শ্রীকৃষ্ণকে বহুবার বুঝিয়েছিলেন যে আমাদের যুদ্ধে জড়ানো উচিত নয়।কারণ দুর্যোধন এবং অর্জুন উভয়েই আমাদের বন্ধু।  এই ধরনের ধর্মীয় সংকটের সময়ে উভয়ের পক্ষ না নেওয়াই সঙ্গত হবে।  কিন্তু কৃষ্ণের কোন প্রকার দ্বিধা ছিল না।  তিনি এই সমস্যার সমাধানও করেছেন।  তিনি দুর্যোধনকে বলেছিলেন যে আপনি আমাকে না হয়  আমার নারায়নী সেনার মধ্যে একটি বেছে নিন।দুর্যোধন তখন কৃষ্ণের নারায়নি সেনা নির্বাচন করলেন।

মহাভারতে উল্লেখ আছে যে,যে সময়ে যুদ্ধের প্রস্তুতি চলছিল সেই সময় একদিন ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বড় ভাই বলরাম হঠাৎ পাণ্ডবদের শিবিরে উপস্থিত হন।  দাউ ভাইয়াকে আসতে দেখে শ্রীকৃষ্ণ, যুধিষ্ঠির প্রমুখ খুব খুশি হলেন।  সবাই তাকে সম্মান করত।  সকলকে অভিবাদন জানিয়ে বলরাম ধর্মরাজের কাছে বসলেন।

তারপর তিনি খুব কষ্টের সাথে বললেন যে আমি কৃষ্ণকে কতবার বলেছি যে আমাদের জন্য পান্ডব এবং কৌরব উভয়ই এক। তাই এই যুদ্ধে আমাদের হস্তক্ষেপ করার দরকার নেই। অর্জুনের প্রতি কৃষ্ণের স্নেহ এতটাই যে তিনি কৌরবদের বিরোধিতা করেন।  এখন কৃষ্ণ যে দিকে আছে তার বিরুদ্ধে যাব কী করে?  ভীম ও দুর্যোধন দুজনেই আমার কাছে গদা শিখেছে।  দুজনেই আমার শিষ্য।  দুজনের প্রতিই আমার সমান স্নেহ।  এই দুই কুরুবংশীকে একে অপরের সাথে যুদ্ধ করতে দেখলে আমার ভালো লাগবে না, তাই আমি তীর্থযাত্রায় যাচ্ছি।


বুদ্ধ অবতার  


ভববান বিষ্ণুর দশ অবতারের মধ্যে নবম অবতার হল বুদ্ধ অবতার। গৌতম বুদ্ধের বাণী পৃথিবীর মানুষকে সুন্দর সঠিক পথে পরিচালিত করার মূল মন্ত্র। গৌতম বুদ্ধের জন্ম ৬২৩ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ এবং নির্বাণ সাল ৫৪৩ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দ । বৌদ্ধ ধর্মের প্রবক্তা হলেন গৌতম বুদ্ধ (পালি: গোতম) বা শাক্যমুনি বুদ্ধ। সিদ্ধার্থ গৌতম তার প্রথম নাম ছিল। তার আধ্যাত্মিক সাধনা এবং জীবন সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনের পরে বুদ্ধ নামটি গ্রহণ করেন। রাজা শুদ্ধোদন ছিলেন সিদ্ধার্থের পিতা অর্থাৎ গৌতম বুদ্ধের পিতা। রাজা শুদ্ধোদন জন্মের পঞ্চম দিনে রাজা ৮ জন জ্ঞানী ব্যক্তিকে সদ্যোজাত শিশুর নামকরণ ও ভবিষ্যৎ বলার জন্য ডাকেন। আর এর পরে তাকে সিদ্ধার্থ নাম দেওয়া হয়। যার অর্থ যে সিদ্ধিলাভ করেছে,বা যার উদ্দেশ্য সফল হয়েছে।

গৌতম বুদ্ধের জন্ম ৬২৩ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ এবং নির্বাণ সাল ৫৪৩ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দ । বৌদ্ধ ধর্মের প্রবক্তা গৌতম বুদ্ধ কে পুরাণ মতে বিষ্ণুর নবম অবতার বলে গণ্য করা হয়। সিদ্ধার্থ গৌতম তার প্রথম নাম ছিল। আধ্যাত্মিক সাধনা এবং জীবন সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনের পরে তার নাম হয় বুদ্ধ। রাজা শুদ্ধোদন ছিলেন সিদ্ধার্থের পিতা অর্থাৎ গৌতম বুদ্ধের পিতা। রাজা শুদ্ধোদন জন্মের পঞ্চম দিনে  ৮ জন জ্ঞানী ব্যক্তিকে সদ্যোজাত শিশুর নামকরণ ও ভবিষ্যৎ বলার জন্য ডাকেন। এর পরে তাকে সিদ্ধার্থ নাম দেওয়া হয়। যার অর্থ যে সিদ্ধিলাভ করেছে,বা যার উদ্দেশ্য সফল হয়েছে।

আট জন ব্যক্তির মধ্যে একজন বলেছিলেন গৌতম বুদ্ধ একদিন সত্যের সন্ধানে বেরিয়ে যাবেন এবং বোধিপ্রাপ্ত হবেন। এছাড়া তিনি অনেক জ্ঞান লাভ করবেন। তিনি বুদ্ধত্ব লাভের জন্য সংসার জীবন ত্যাগ করে নির্জনে বসে তার সাধনা চালিয়ে গিয়েছিলেন। এর ফল স্বরুপ তিনি সকলের মাঝে দিতে পেরেছেন বুদ্ধ ধর্ম। 


এক সময় পৃথিবীতে অসুরদের শক্তি অনেক বেড়ে গিয়েছিল।  অসুরদের সামনে দেবতাদের ক্ষমতা ও তেজ কমে যেতে থাকল।  অতঃপর অসুররা স্বর্গ দখল করল।"

সাম্রাজ্য স্থিতিশীল হবার রহস্য জানার জন্য রাক্ষসরা দেবতা ইন্দ্রকে  জিজ্ঞাসা করলেন - "আমাদের সাম্রাজ্য স্থিতিশীল হওয়ার সমাধান কী?  

তখন দেবরাজ ইন্দ্র উত্তর দিলেন- "স্থিতিশীল শাসনের জন্য যজ্ঞ ও ধর্ম আবশ্যক।  

অসুররা তখন ধর্মের আশ্রয় নিয়ে যজ্ঞের আচার শুরু করে।  ফলে দিন দিন তাদের ক্ষমতা বাড়তে থাকে।  পৃথিবীতে পৈশাচিক শক্তি ছড়িয়ে পড়তে থাকে।

পরাজিত হয়ে দেবতারা ভগবান বিষ্ণুর শরণাপন্ন হন এবং এই কষ্ট থেকে রক্ষা করার জন্য প্রার্থনা করেন।  তখন ভগবান বিষ্ণু আশ্বস্ত করে এবং বুদ্ধের অবতার গ্রহণ করেন।

এইভাবে ভগবান বুদ্ধ  অসুরদের উপদেশ দিলেন – “যজ্ঞ করা পাপ।  যজ্ঞ হিংসার দিকে নিয়ে যায়।  যজ্ঞের জ্বলন্ত অগ্নিতে এতগুলো আত্মা ভস্মীভূত হয়।

ভগবান বুদ্ধের শিক্ষা শুনে অসুরেরা ভীষণভাবে প্রভাবিত হয়েছিল। তারা যজ্ঞ ও বৈদিক সাধনা ত্যাগ করেন।  ফলে কিছুক্ষণের মধ্যেই তাদের শক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে।

দেবতারা এই সময়ের জন্য অপেক্ষা করছিলেন।তাই দেবতারা অসুরদের আক্রমণ করে তাদের পরাজিত করলেন।  দেবতারা আবার স্বর্গের উপর নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেলেন।


বুদ্ধের উপদেশ :

"মা যেমন তাঁর নিজ পুত্রকে নিজের জীবন দিয়ে রক্ষা করে তেমনি সকল প্রাণীর প্রতি অপরিমেয় মৈত্রীভাব পোষণ করবে।"

"যিনি উপদেশ দেন, অনুশাসন করেন এবং অসভ্যতা নিবারণ করেন তিনি অসত্যের অপ্রিয় এবং সৎলোকের প্রিয় হন।"

"ভালো কাজ সবসময় কর। বারবার কর। মনকে সবসময় ভালো কাজে নিমগ্ন রাখো। সদাচরাণই স্বর্গসুখের পথ।প্রাজ্ঞ ব্যক্তি কখনো নিন্দা বা প্রশংসায় প্রভাবিত হয় না।"

"সকলেই দণ্ডকে ভয় করে, জীবন সকলের প্রিয়। সুতরাং নিজের সাথে তুলনা করে কাকেও প্রহার করবে না কিংবা আঘাত করবে না।"

"মৈত্রী দ্বারা ক্রোধকে জয় করবে, সাধুতার দ্বারা অসাধুকে জয় করবে, ত্যাগের দ্বারা ক্রোধকে জয় করবে ও সত্যের দ্বারা মিথ্যাকে জয় করবে।"


কল্কি অবতার  


ভববান বিষ্ণুর দশ অবতারের মধ্যে দশম অবতার হল কল্কি অবতার।এটি ভগবান বিষ্ণুর দশম অবতার যিনি কলিযুগের শেষ পর্বে অবতীর্ণ হবেন।এখন এটি কলিযুগের প্রথম পর্ব।তারপর থেকে পাঁচ হাজার বছরেরও বেশি সময় কেটে গেছে।

কলিযুগের বয়স যত বাড়তে থাকবে ততই পৃথিবী থেকে ধর্মের ক্রমাগত বিলুপ্তি ঘটবে এবং মানুষের নৈতিক অবক্ষয়ও বাড়বে।  সর্বত্র পাপ, বেদনা, দুঃখ, অত্যাচার ছড়িয়ে পড়বে।

সেই সময় ওড়িশা রাজ্যের সম্বল গ্রামে বিষ্ণুয়াশা নামে একজন অত্যন্ত ধার্মিক, গুণী ও মহৎ ব্রাহ্মণের ঘরে ভগবান বিষ্ণু কল্কি অবতার রূপে অবতীর্ণ হবেন। 

তিনি মহান বুদ্ধিমত্তা ও পরাক্রম, মহাত্মা, গুণী হবেন। সেই পরম ধার্মিক ভগবান কল্কি পৃথিবী থেকে সমস্ত পাপী,  দুষ্ট, দুরাচারীদের ধ্বংস করবেন।পুনরায় ধর্মের উত্থান শুরু হবে এবং পৃথিবীতে আবার সত্যযুগ প্রতিষ্ঠিত হবে।


ভগবান বিষ্ণু জগতবাসীর কল্যাণ এবং বিশ্বজগতের সুরক্ষার জন্য,অধর্মকে বিনাশ করে ধর্মকে আবার পুনঃ প্রতিষ্ঠিত করার জন্য,দুষ্টের দমন এবং সৃষ্টির পালন করার জন্য বার বার এই ধরাই অবতার রূপে এসেছেন।আর সেই কারনেই ভগবান বিষ্ণুর এই দশ অবতারের সৃষ্টি।


 গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন - 


"যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত অভ্যুত্থানম ধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্ পরিত্রাণায় সাধুনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্ ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে।"


ধন্যবাদ  :  By Indian mythology


    

    

    

    




    



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ