ভক্তি কাকে বলে? ভক্তি কত প্রকারের? ভক্তিযোগ কাকে বলে? ( What is devotion? How many types of devotion? What is Bhakti Yoga? )

 

ভক্তি কাকে বলে? ভক্তি কত প্রকারের? ভক্তিযোগ কাকে বলে? ( What is devotion?  How many types of devotion? What is Bhakti Yoga? )


ভক্তি কাকে বলে?
ভক্তি DEVOTION


ভক্তি কাকে বলে?


শ্রী নারদ পঞ্চরাতে বলা হয়েছে -

সর্বোপাধিবিনির্মুক্তং তৎপরত্বেন নির্মলম্ ।

হৃষীকেণ হৃষীকেশসেবনং ভক্তিরুচ্যতে ।।


"সর্ব উপাধিমুক্ত অর্থাৎ কৃষ্ণ সুখকামনা ব্যতীত ইহজীবনের ও পরজীবনের সমস্ত প্রকার আত্মেন্দ্রিয় সুখ কামনা বর্জন করে, কেবল শ্রীকৃষ্ণপ্রীতির জন্য ইন্দ্রিয়সমূহ দিয়ে ইন্দ্রিয়ের নিয়ামক শ্রীকৃষ্ণের সেবা করাকেই ভক্তি বলা হয়।"


ভগবানকে ভালোবাসাই ভক্তি। হৃষীকেণ হৃষীকেশসেবনং ভক্তিরুচ্যতে । আমাদের ইন্দ্রিয় সমূহ দিয়ে শ্রীকৃষ্ণের সেবা করাটাই ভক্তি।আমাদের ইন্দ্রিয়গুলী যখন শ্রীকৃষ্ণ সেবায় নিযুক্ত হয় তখন ভক্তির উদয় সম্ভব হয়।

পাঁচটি জ্ঞানেন্দ্রিয় চোখ-কান-নাক-জিভ- ত্বক,পাঁচটি কর্মেন্দ্রিয় বাক-পাদ-পানি-পায়ু- উপস্থ এবং একটি অন্তরিন্দ্রিয় মন - এ সব ইন্দ্রিয় ভগবৎসেবায় যুক্ত হলে ভক্তির উদয় হবে।চোখ দিয়ে ভগবৎ বিগ্রহের রূপ দর্শন করা,কান দিয়ে ভগবানের মহিমা কীর্তন শ্রবণ করা, নাক দিয়ে ভগবানের অর্পত প্রসাদি তুলসী-চন্দন পুষ্পের ঘ্রান নেওয়া, জিহ্বা দিয়ে কৃষ্ণনাম কীর্তন করা এবং ভগবৎ চরণামৃত ও অধরামৃত আস্বাদন করা,ত্ব দিয়ে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করা এবং ভক্তপদরেণুতে ভূষিত হওয়া,বাক শক্তি দিয়ে হরিকথা কীর্তন করা,হাত দিয়ে মন্দির মার্জন ও অন্যান্য ভগবদ্ সেবা করা,পায়ু দিয়ে ভগবদ সেবার অনুকূল শরীরটার মধ্যে বর্জ্য পদার্থ নিষ্কাশন করা, উপস্থ ইন্দ্রিয় দিয়ে গৃহস্থ ব্যক্তির ভগবদ্ভক্ত সন্তান উৎপাদনের জন্য মাত্র ব্যবহার করা, এবং মন দিয়ে পরমেশ্বরের প্রীতি সাধনার্থে সেবা করে চলা।


ভক্তি কত প্রকারের?


ভক্তি সাধারণত দুই রকমের। মিশ্র ভক্তি এবং শুদ্ধ ভক্তি।

যখন জড়জাগতিক কোনরকম কামনা বাসনা পূরণের জন্য ভক্তি অনুসরণ করা হয় তখন তাকে মিশ্র ভক্তি বলে। ক্রোধি, হিংসুক, দাম্ভিক,মাৎসর্য পরায়ন ব্যক্তিরা যখন ভগবানের ভক্তি করে, তাদের সেই ভক্তি তামসিক।

বিষয় যশঐশ্বর্য লাভের উদ্দেশ্যে ভগবানের প্রতি যে ভক্তি করা হয় তা রাজসিক ভক্তি।

সকাম কর্মের ফল থেকে মুক্ত হওয়ার উদ্দেশ্যে কর্মের ফল ভগবানকে নিবেদন পূর্বক যে ভক্তি করা হয় তা সাত্ত্বিক ভক্তি।

কিন্তু এইসবই হল মিশ্র ভক্তি।


শুদ্ধ ভক্তি - অন্ন্যাভিলাষীতাশূন্যং জ্ঞানকর্মাদ্যনাবৃতম্।

শ্রীকৃষ্ণের সেবা ছাড়া অন্য কোন অভিলাষ থাকবে না। মায়াবাদীদের শুষ্ক জ্ঞান এবং সকাম কর্ম বন্ধন থেকে মুক্ত থেকে নিজের ইচ্ছামত না করে শ্রীকৃষ্ণের ইচ্ছার অনুকূলে প্রীতিপূর্বক নিরন্তর সেবা অনুষ্ঠান করাই উত্তম ভক্তি বা শুদ্ধ ভক্তি।

ভক্তিরসামৃতসিন্ধু গ্রন্থে আরো বলা হয়েছে, প্রামাণ্য বৈদিকশাস্ত্র কে অবহেলা করে যে হরিভক্তি তা সমাজের উৎপাত মাত্র।

শ্রুতিস্মৃতি-পুরাণাদি-পঞ্চরাত বির্ধি বিনা ।ঐকান্তিক হরের্ভক্তিঃ উৎপাতায়ৈব কল্পতে ।।বৈদিক শাস্ত্রকে অবজ্ঞা করে যে ঐকান্তিক ভাব দেখিয়ে হরিভক্তি অনুষ্ঠিত হয় তা শুধু উৎপাতই সৃষ্টি করে।


ভক্ত কাকে বলে? প্রকৃত ভক্তের লক্ষণ গুলি কি কি?


যাদের জীবনের কেন্দ্র হল ভগবান শ্রী হরি, যাদের লক্ষ্য হল কৃষ্ণ কৃপা লাভ করা তারাই ভক্ত।


আর যাদের জীবনের কেন্দ্র হল জাগতিক সম্পদ,যাদের লক্ষ্য হলো ইন্দ্রিয় সুখ লাভ করা তারাই কর্মী বা অভক্ত।


প্রকৃত ভক্তের লক্ষণ কি?


শ্রীমৎভাগবতে বর্ণনা আছে যে, পরম ভক্ত শ্রী উদ্ধব যখন ভগবদ্ভক্তি সম্বন্ধে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কে জিজ্ঞাসা করেন তখন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এই কথা বলেছিলেন -


আদরঃ পরিচর্যায়াং সর্বাঙ্গেরভিবন্দনম্ ।

মদ্ভক্তপূজাভ্যধিকা সর্বভূতেষু মন্মতিঃ ।।

মদর্থষ্বঙ্গচেষ্টা চ বচসা মদ্গুণেরণম্ ।

ময্যর্পমঞ্চ মনসঃ সর্বকামবিবর্জনম্ ।।


অর্থাৎ

১। আদরের সঙ্গে আমার পরিচর্যা করা।

২। সর্বাঙ্গের দ্বারা আমার অভিনন্দন করা।

 ৩। বিশেষভাবে আমার ভক্তের পূজা করা। 

৪। সমস্ত জীবকে আমার সঙ্গে সম্পর্কিত বলে মনে করা।

৫। দেহের সমস্ত ক্ষমতা দিয়ে আমার সেবা করার।

৬। বাক্যের দ্বারা আমার মহিমা কীর্তন করা।

৭। মনকে আমাতে অর্পণ করা এবং

৮। সবরকম জড় ভোগবাসনা পরিত্যাগ করা।

এই গুলি হল প্রকৃত ভগবদ্ভক্তের লক্ষণ।


ভগবানের শুদ্ধ ভক্তের গুণ কি?


শুদ্ধ ভক্তের সবচাইতে মহৎপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে তিনি লম্পট বা অসংযমী নন, এবং তার আরেকটি গুণ হচ্ছে যে তিনি সর্বদা অপরের দুঃখ দূর করার জন্য উৎকণ্ঠিত থাকেন।জীবের সবচেয়ে জঘন্য দুর্দশা হলো তার কৃষ্ণবিস্মৃতি অর্থাৎ পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে ভুলে থাকা।ভগবানের শুদ্ধভক্ত সর্বদা সকলের হৃদয়ে কৃষ্ণভাবনা জাগরিত করার চেষ্টা করেন। আর সেটিই হচ্ছে সমগ্র ক্লেশের সর্বশ্রেষ্ঠ মহৌষধ। (ভাঃ ৩/১৪/৪৯ প্রভুপাদ তাৎপর্য )।



ভক্তিযোগ কাকে বলে?

ভক্তি যোগকে আক্ষরিক অর্থে ভক্তি মার্গও বলা হয়। এটি হল হিন্দুধর্মের একটি আধ্যাত্মিক পথ বা আধ্যাত্মিক অনুশীলন যা কোনো দেবতার প্রতি প্রেমময় ভক্তির ন্যায় দৃষ্টিপাত করে। হিন্দুধর্মের মধ্যে যে তিনটি শাস্ত্রীয় পথ রয়েছে এটি হল তার মধ্যে একটি।যা জীবকে মোক্ষ লাভের পথে নিয়ে যায়।অন্য দুটি পথ হল জ্ঞান যোগ এবং কর্ম যোগ।  



ভক্তি বড়, না জ্ঞান বড়?


ভক্তি সব সময় বড়। ভক্তিকে জানাই হচ্ছে প্রকৃত জ্ঞান। ভক্তিহীনতাই হচ্ছে অজ্ঞান।রাবণ,কংস,হিরণ্যকশিপু ইত্যাদি দুর্ধর্ষ রাজগণ বড় বড় জ্ঞানী,দার্শনিক ও রাজনীতিবিদ ছিলেন, কিন্তু ভগবদ্ভক্তিহীনতার জন্য তাদের কাছে ভগবান নিষ্ঠুর মহাকালরূপী মৃত্যুরূপে আবির্ভূত হয়ে তাদের নিধন করেছিলেন। কিন্তু ধ্রুব,প্রহ্লাদ ইত্যাদির রাজাগণ শৈশব থেকে ভগবদ্ভক্তি অনুশীলন করেছিলেন, তাই ভগবান তাদের সর্বাবস্থায় রক্ষা করেছিলেন এবং কৃপার্শীবাদ দান করেছিলেন।ভগবান বলেছেন - ভক্ত্যা মাম্ অভিজানাতি  -  ভক্তির দ্বারাই আমাকে জানতে পারবে।ন মেধয়া ন বিদ্যয়া লভ্যঃ - বিদ্যা ও জ্ঞানচর্চার দ্বারা আমাকে জানা যায় না।

শ্রীমদ্ভাগবতে বলা হয়েছে  -" বাচস্পতিগণ বহু তপস্যা, বিদ্যা ও সমাধি দ্বারা বহু অনুসন্ধান করেও সর্বসাক্ষী পরমেশ্বর কে জানতে পারেন নি।" 

( ভাঃ ৪/২৯/৪৪ )


ভগবদ্গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন - "যোগীই তপস্বী অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। জ্ঞানী কর্মী অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠ।

হে অর্জুন ! তুমি যোগী হও, যে যোগী আমাতে আসক্ত হয়ে সর্বান্তকরণে আমাকে (শ্রীকৃষ্ণকে ) ভজনা করেন, তিনিই সর্বশ্রেষ্ঠ যোগী। ইহাই আমার অভিমত।"


শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন -


তেষাং সততযুক্তানাং ভজতাং প্রীতিপূর্বকম্।

দদামি বুদ্ধিযোগং ত্বং যেন মামুপর্যান্তি তে ।।


"নিত্য ভক্তিযোগ দ্বারা যারা সর্বদা প্রীতির সঙ্গে আমার ভজনা করেন,তাদের আমি শুদ্ধ জ্ঞানজনিত সেই বিমল প্রেমযোগ দান করি,  যা দিয়ে তারা যা দিয়ে তারা আমার পরমানন্দধাম প্রাপ্ত হন।"  (গীতা ১০/২০ )


ভক্তিপথে বিধিমার্গ আর রাগমার্গ কি?


কিভাবে কৃষ্ণভক্তি অনুসরণ করতে হয় সেই শিক্ষা গ্রহণ করে কৃষ্ণভক্তি অভ্যাস করাকে বিধিমার্গ বলে। কিন্তু যখন সেই অনুশীলন করতে করতে কোন ব্যক্তির ভগবানের জন্য তীব্র প্রেম-অনুরাগে জাগে তখন স্বাভাবিকভাবেই স্বতঃস্ফূর্ত কৃষ্ণানুরাগবশে কৃষ্ণভক্তি সম্পাদন করাকে রাগমার্গ বলে।



উত্তম ভক্ত,মধ্যম ভক্ত ও কনিষ্ঠ ভক্তের মধ্যে পার্থক্য কি?


 শ্রীমদ্ভাগবতে (১১/২/৪৫-৪৭)বর্ণিত আছে - যিনি আকাশ বায়ু অগ্নি জল প্রভৃতি পদার্থসমূহকে শ্রীহরির শরীর জ্ঞান প্রমাণ করেন।চেতন-অচেতনের সর্বভূতে আত্মাভীষ্ট ভগবদ্ভাব অবলোকন করেন, আত্মমধ্যে ভগবান এবং ভগবানে সর্বভূতকে দর্শন করেন তিনি উত্তম ভাগবত।

যিনি পরমেশ্বরের প্রতি ভক্তিপরায়ন, ভক্তদের প্রতি মৈত্রী বন্ধুভাবাপন্ন,অনভিজ্ঞ উদাসীনদের প্রতি কৃপাপরায়ণ, বিদ্বেষীদের প্রতি উপেক্ষা ভাব রাখেন,কিন্তু উত্তম ভক্তদের মতো সর্বত্র যার প্রেমের স্ফূর্তি হয় না,তিনিই মধ্যম ভক্ত।

যিনি অর্চনাবিগ্রহের যত্নসহকারে পূজা করে থাকেন কিন্তু ভক্তকে শ্রদ্ধা করেন না, তিনিই কনিষ্ঠ ভক্ত।


ধন্যবাদ : indianmythologyrk.blogspot.com



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ