'একলব্য' মহাভারতের এক অনন্য কাহিনী : যার জীবনী, গুরুদক্ষিণা ও পুনর্জন্মের কাহিনী কখনো ভোলার নয় : ( 'Eklavya' is a unique story of Mahabharata whose biography, gurudakshina and rebirth are never to be forgotten) :

 

'একলব্য' মহাভারতের এক অনন্য

 কাহিনী : যার জীবনী, গুরুদক্ষিণা ও

 পুনর্জন্মের কাহিনী কখনো ভোলার নয় :


( 'Eklavya' is a unique story of Mahabharata whose biography, gurudakshina and rebirth are never to be forgotten) :


মহাভারত একটি অদ্ভুত মহাকাব্য, যা হিন্দু সাহিত্যের অপরিহার্য অংশ। এই মহাকাব্যের একটি মহান চরিত্র হলো "একলব্য"। তাঁর বিখ্যাত কাহিনী "গুরুদক্ষিণা" মহাভারতের একটি অপরিহার্য অংশ। তবে 'একলব্য' মহাভারতের একটি ছোটখাটো চরিত্র হলেও বেশ  তাৎপর্যপূর্ণ। 'একলব্য' মহাভারতের এক অনন্য কাহিনী যার জীবনী,গুরুদক্ষিণা এবং পুনর্জন্মের কাহিনী  আমাদেরকে অদ্ভুত শিক্ষা দেয়।


 
একলব্যের গুরু দক্ষিণা  


মহাভারত মহাকাব্যের এক অনন্য চরিত্র 'একলব্য' :


মহাভারত মহাকাব্যের এক অনন্য চরিত্র 'একলব্য' এবং একটি গৌরবময় সন্ধান। তাঁর গুরুদক্ষিণা, জীবনী এবং পুনর্জন্মের কথা আমাদেরকে সুন্দর শিক্ষা দেয় - যে পরিশ্রম, সংযমশীলতা এবং আত্মবিশ্বাস হলো একটি ব্যক্তির সফলতার প্রধান সূত্র। আমরা সবাই একলব্য থেকে শিক্ষা নিতে পারি যে কখনও হারার আগে হারবো  না। কঠোর অধ্যাবসায় ও পরিশ্রমের মাধ্যমে লক্ষ্য পূরণ করতে হবে এবং একলব্যের মতো আমাদের জীবনকে সফলতার শীর্ষে পৌঁছাতে হবে। 

আসুন আমরা সবাই একলব্যের বীর্য এবং অনুশাসনের উদাহরণ অনুসরণ করে আমাদের জীবনকে চরম সফলতার পথে এগিয়ে নিয়ে যায়। 



Table of Content 


  • জীবনী 


  • গুরুদক্ষিণা 


  • শ্রীকৃষ্ণের হাতে মৃত্যু 


  • পুনর্জনম 




একলব্যের জীবনী


'হরিবংশ' পুরাণ মতে একলব্য ছিলেন যাদব শ্রেষ্ঠ বসুদেবের ভাই দেবশ্রবের পুত্র অর্থাৎ শ্রী কৃষ্ণের খুড়তুতো ভাই।


একলব্য যখন জন্মগ্রহণ করেছিলেন সেই সময় আকাশ থেকে দৈব বাণী হয়েছিল যে - এই পুত্রের যদু বংশের হাতেই মৃত্যু হবে।

সেই ভয়ে পিতা দেবশ্রব পুত্রকে রক্ষা করার জন্য শিশুটিকে নদীর জলে ভাসিয়ে দেন। 


একদিন  নিষাদের রাজা ব্যাতরাজ হিরণ্যধনুশ বনে স্বীকার করতে গিয়ে নদী থেকে শিশুটিকে উদ্ধার করে এবং তাকে দত্তক নিয়েছিলেন ও প্রতিপালন করে বড় করে তুলেছিলেন। শিশুটির নাম রেখেছিলেন 'একলব্য'। 


এক লব্য মনে মনে সংকল্প করেছিলেন যে তিনি একজন মহান তীরন্দাজ ও সাহসী যোদ্ধা হবেন। তাই তিনি তার পিতা হিরণ্যধনুশের কাছে এই ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন এবং তার পিতাকে বলেছিলেন পিতা  আমি একজন দক্ষ তীরন্দাজ হতে চাই এবং মহান গুরু দ্রোণাচার্যের শিষ্য হতে চাই। আমি তাঁর গুরুকুলে যাওয়ার আগে দয়া করে আমাকে আপনার আশীর্বাদ করুন।


তার পিতা দেবশ্রব চুপ করে রইলেন। তখন একলব্য বললেন পিতা আমি জানি আমরা শূদ্র, শিকারী গোত্রের লোক।  কিন্তু গুরু দ্রোণাচার্য একজন জ্ঞানী ও বিদ্বান মানুষ।  তিনি আমাকে নিরাশ করবেন না। দয়া করে আমাকে তাঁর শিষ্য হতে আদেশ দিন।


একলব্যের পিতা একজন দয়ালু মানুষ ছিলেন এবং তাঁর ছেলেকে প্রত্যাখ্যান করতে চাননি।  তাই তিনি আশীর্বাদ দিলেন এবং তাঁর পুত্রকে গুরু দ্রোণাচার্যের কাছে পাঠালেন।


একলব্য গুরু দ্রোণাচার্যের গুরুকুলে পৌঁছেছিলেন – যিনি পাণ্ডব ও কৌরবদেরও শিক্ষক ছিলেন।  


 একলব্য দ্রোণের কাছে গিয়ে হাত জোড় করে অভিবাদন জানালেন। ঋষির চরণ স্পর্শ করার জন্য নীচু হয়ে প্রণাম করলেন।  আগন্তুককে দেখে দ্রোণ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, "কে তুমি?"


গুরুদেব আমি একলব্য, হস্তিনাপুরের বনে শিকারীদের নিষাদ গোত্রের প্রধান হিরণ্যধনুশের  পুত্র।  অনুগ্রহ করে আমাকে আপনার শিষ্য হিসেবে গ্রহণ করুন এবং আমাকে ধনুর্বিদ্যা এবং যুদ্ধবিদ্যা শেখান। 


দ্রোণাচার্য এক মিনিটের জন্য ভাবলেন তারপর বললেন, 'একলব্য, তুমি যদি নিষাদ জাতি  হও, তবে তুমি শূদ্র, এই রাজ্যের সর্বনিম্ন জাতি।  আমি ব্রাহ্মণ বর্ণের মধ্যে সর্বোচ্চ।  আমার সকল ছাত্র ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় জাতি। আমি শূদ্রের ছেলেকে অস্ত্রশিক্ষা দিতে পারিনা। 


পাণ্ডবরা দাঁড়িয়ে শুনছিলেন গুরু দ্রোণাচার্য এবং একলব্যের কথা।  গুরুর কথায় উৎসাহিত হয়ে অর্জুন বললেন, শোনো অর্বাচীন - গুরু দ্রোণাচার্য হলেন একজন রাজকীয় শিক্ষক। যাকে আমাদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য রাজা নিযুক্ত করেছেন।  আপনি তার কাছে এসেছেন অস্ত্রশিক্ষা নিতে? আপনার সাহস তো কম নয়? যান এখন গুরুকুল ত্যাগ করুন।



একলব্যের গুরু ভক্তি এবং গুরুদক্ষিণা :



গুরু দ্রোণাচার্যের কথায় একলব্য  বিস্মিত ও আহত হন এবং অর্জুনের অপমানে হতবাক হন।  তিনি একজন প্রধানের ছেলে ছিলেন, তবুও তিনি কাউকে কোনদিন অপমান করেননি। তিনি নিঃশব্দে গুরুকুল ছেড়ে চলে গেলেন। ধনুর্বিদ্যা শেখার দৃঢ় সংকল্প নিয়ে তিনি বনে ফিরে গেলেন।  সেখানে তিনি মাটি দিয়ে গুরু দ্রোণাচার্যের একটি মূর্তি নির্মাণ করেন এবং একটি নির্জন স্থানে স্থাপন করেন।  একলব্য দৃঢ়ভাবে  বিশ্বাস করতেন যে তিনি যদি তার গুরুর প্রতিমূর্তি সামনে রেখে গভীরভাবে অনুশীলন করেন তবে তিনি ধনুর্বিদ্যায় একদিন না একদিন দক্ষতা অর্জন করতে সক্ষম হবেন।  তাই প্রতিদিন সকালে তিনি মাটির তৈরি গুরুর প্রতিমূর্তির কাছে প্রার্থনা করতেন এবং সারাদিন অনুশীলন করতেন।  বছরের পর বছর অনুশীলন করার পর তিনি একজন দক্ষ তীরন্দাজ হয়ে ওঠেন।এমনকি রাজ্যের সেরা তীরন্দাজ - অর্জুনকেও ছাড়িয়ে যান।



একদিন নির্জন বনে অনুশীলন করার সময় তার কুটিরের কিছু দূরে একটি কুকুর ঘেউ ঘেউ করতে শুরু করে। এতে তার অনুশীলনে ব্যাঘাত ঘটতে থাকে। তাই তিনি এমনভাবে সাতটি তীর নিক্ষেপ করে কুকুরের মুখ বন্ধ করলেন অথচ কুকুরটিকে কোনরকম আঘাত না করেই।  


কুকুরটি ছটফট করতে করতে গুরু দ্রোণাচার্যের সাথে বনে অনুশীলনকারী পান্ডবদের কাছে পৌঁছে গেল। ধনুর্বিদ্যার এমন কীর্তি দেখে দ্রোণ বিস্মিত হলেন।  তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে কেবল একজন অত্যন্ত দক্ষ তীরন্দাজই এটি করতে পারে।  তাই তিনি পাণ্ডবদের সাথে তীরন্দাজকে খুঁজতে বের হলেন।


শীঘ্রই তারা একটি যুবককে দেখতে পেলন। শিকারীর পোশাক পরে তীরন্দাজ অনুশীলন করছে।  এটাই ছিল 'একলব্য।'


দ্রোণাচার্য তাঁর কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন- আপনার লক্ষ্য অসাধারণ!  তোমার শিক্ষক কে?"


একলব্য উত্তর দিলেন আমার গুরুদেব হচ্ছেন স্বয়ং 'আপনি।'


একথা শুনে দ্রোণাচার্য হতবাক হয়ে গেলেন। এবং প্রশ্ন করলেন আমি কিভাবে আপনার গুরু হতে পারি? যেহেতু আপনার সঙ্গে আমার আগে কখনো দেখা হয়নি এবং আমি আপনাকে চিনি না।  


তখন একলব্য উত্তর দিলেন - আমি একলব্য। আমিই সেই ছেলে যে আপনার  গুরুকুলে গিয়েছিল আপনার কাছে তীরন্দাজ শিখতে। কিন্তু আপনি সেদিন আমাকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তারপর আমি বনে ফিরে এসে আপনার একটি মাটির মূর্তি তৈরি করে প্রতিদিন প্রার্থনা করতাম এবং আপনার আশীর্বাদ চাইতাম যাতে আমি একজন দক্ষ তীরন্দাজ হতে পারি। আপনার আশীর্বাদে সেই আজ আমি তীরন্দাজ শিক্ষায় দক্ষতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছি।


অর্জুন রাগান্বিত হলেন কারণ তিনি নিজেকে বিশ্বের সেরা তীরন্দাজ হিসাবে মনে করতেন। দ্রোণাচার্য শীর্ষ অর্জনকে কথা দিয়েছিলেন যে তোমাকেই আমি একদিন বিশ্বের শ্রেষ্ঠ তীরন্দাজে পরিণত করব। এবং তুমিই হবে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ কিরনবাজ।  দ্রোণাচার্যও বুঝতে পেরেছিলেন যে একলব্যের মধ্যে অর্জুনকেও ছাড়িয়ে যাওয়ার দক্ষতা রয়েছে।  


দ্রোণাচার্য তার শিষ্য অর্জনকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি পূরণ করার জন্য এবং অর্জুনের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার জন্যই একটি উপায় বের করেছিলেন।  একলব্যকে তিনি বলেছিলেন যে আপনি যেহেতু আমাকে গুরু বলে মেনেছেন এবং তীরন্দাজ এর দক্ষতা অর্জন করেছেন তাই এবার গুরুদক্ষিণা দিতে হবে। আর গুরুদক্ষিণা না দিলে তো কোন দক্ষতা বা কর্ম সফল হয় না তাই এখন তোমাকে অবশ্যই গুরুদক্ষিণা দিতে হবে। 


একলব্য এতে আনন্দিত হলেন।  গুরুদক্ষিণা হল একজন শিক্ষককে দেওয়া শ্রেষ্ঠ উপহার। একলব্য বললেন - আমি ধন্য যে আপনি আমার কাছে গুরুদক্ষিণা চেয়েছেন। আপনি গুরুদক্ষিণা হিসেবে যা চাইবেন তাই দেব। কখনোই অস্বীকার করব না।


এই সময় দ্রোণাচার্য তার সুযোগটি কাজে লাগালেন।এবং বললেন - একলব্য, গুরু দক্ষিণা হিসেবে তোমাকে তোমার ডান বুড়ো আঙুল কেটে দিতে হবে।


তখন সবাই হতবাক! কারণ সবাই জানত যে একজন তীরন্দাজ তার ডান বুড়ো আঙুল ছাড়া তীর ছুঁড়তে পারে না।


একলব্য স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন দ্রোণাচার্যের দিকে।  এই দাবির পেছনের কারণ বুঝতে পেরেছেন তিনি।  তবুও তিনি উত্তর দিলেন, আমি কখনই আপনার ইচ্ছা অমান্য করব না গুরুদেব। আমি কৃতজ্ঞ যে আপনি আমাকে আপনার শিষ্য মেনেছেন যদিও আমি শূদ্র।


এই বলে তিনি একটি ছুরি নিয়ে তার ডান হাতের বুড়ো আঙুল কেটে গুরুর পায়ের কাছে রাখলেন।


দ্রোণাচার্য সহ সকলেই ছেলেটির সাহস দেখে বিস্মিত। দ্রোণাচার্য নম্র হয়ে একলব্যকে আশীর্বাদ করেছিলেন, তুমি বুড়ো আঙুল ছাড়াই সারা বিশ্বে  একজন মহান তীরন্দাজ হিসেবে পরিচিত হবে।  তাছাড়া আপনার গুরুর প্রতি মহান আনুগত্যের জন্য আপনাকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ছাত্র হিসেবে স্মরণ করা হবে। এই বলে দ্রোণাচার্য ও পাণ্ডবরা বন ছেড়ে চলে গেলেন।


একলব্য তর্জনী এবং মধ্যমা আঙুল দিয়ে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে তীর ছুঁড়তে পারেন। আজ অবধি একজন আদর্শ ছাত্রের উদাহরণ হয়ে আছেন।



শ্রীকৃষ্ণের হাতে মৃত্যু :


"হরিবংশ পুরাণে" বর্ণিত আছে। যখন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁর মামা কংসকে মারেন তখন কংসের শ্বশুর জরাসন্ধ অত্যন্ত রাগান্বিত হন শ্রীকৃষ্ণের প্রতি। মগধের এই সম্রাট কংসের মৃত্যুর  প্রতিশোধ নেবার  জন্য বার বার মথুরা আক্রমণ করেন। এবং প্রতিবারেই তারা পরাজিত হন। সেই সময়  জরাসন্ধ জানতে পারেন যে তাঁর রাজ্যে একলব্য এর মত একজন অতীব দক্ষ তীরন্দাজ আছে। সেই কারণে তিনি একলব্যকে তাঁর সেনাপতি নিযুক্ত করেন। সেনাপতি হিসাবে নিয়োগ পেয়ে একলব্য যাদব সেনাবাহিনীর বড় অংশ নষ্ট করে দেন। তাঁর এই অদ্ভুত প্রতিভা দেখে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নিজেই তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাকে হত্যা  করেন। এভাবেই দৈব বাণী সত্যি হয় এবং একলব্যের জীবন শেষ হয়।



একলব্যের পুনর্জনম :

 

দৃষ্টদ্যুম্ন রূপে একলব্য


এটা বিশ্বাস করা হয় মৃত্যুর সময় একলব্য কৃষ্ণের কাছে বর চেয়েছিলেন যে আমায় পুনর্জনম দিন এবং আমি যাতে দ্রোণাচার্যকে বধ করতে পারি। তাই শ্রীকৃষ্ণ একলব্যের মৃত্যুর সময় বর দিয়েছিলেন যে তিনি দ্রোণাচার্যকে হত্যা করার জন্য পুনর্জন্ম গ্রহণ করবেন। কথিত আছে যে একলব্যই দৃষ্টদ্যুম্ন রূপে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং অবশেষে দ্রোণাচার্যকে হত্যা করেছিলেন।



উপসংহার :


উপরের আখ্যানটি একলব্যের আত্ম-প্রেরণা এবং দৃঢ় সংকল্প ও তার নৈপুণ্যের প্রতি অটল বিশ্বাসের এক জ্বলন্ত প্রতীক। 

একলব্যের চরিত্রটি স্ব-শৃঙ্খলা, আত্ম-প্রেরণা এবং আত্মবিশ্বাসের গুণাবলীর প্রত্যক্ষ উদাহরণ। 

সামগ্রিকভাবে, একলব্যের চরিত্রটি তীরন্দাজের প্রতি তার অপরিসীম আবেগ, বাধা অতিক্রম করার দৃঢ় সংকল্প এবং তার নৈপুণ্যের প্রতি তার অটল অঙ্গীকার ও গভীর গুরু ভক্তি  দ্বারা চিহ্নিত করা হয়েছে।   


ধন্যবাদ 



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ